লেগ স্ট্যাম্পে শোয়েব আখতারের ভয়ঙ্ককর এক ইয়র্কার। রাজিন সালেহ ব্যাটে খেলতে পারেননি। খেলবেন কী করে? চোখেই যে দেখতে পাননি! বল আঘাত হানে সরাসরি বুটে। এলবিডব্লিউর আবেদন করা হলেও তা নাকচ করে দেন আম্পায়ার।
তারপর থেকে বুক উচ্চতায় ধেয়ে আসতে শুরু করে শোয়েবের একের পর এক বাউন্সার। রাজিনও বুক চিতিয়ে সেগুলো সফলতার সাথে সামাল দেন। বাউন্সারগুলা শরীরে নিয়ে হলেও উইকেট দিবেন না – এ পণ করে করাচির বাইশ গজে মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন তিনি। প্রায় পাঁচ ঘন্টা উইকেটে থেকে খেলেন ৬০ রানের একটি ইনিংস। মাত্র বিশ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেকে রাজিন সালেহর এমন লড়াকু মনোভাবে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে সতীর্থদের মাঝে, বিস্ময় ছড়ায় প্রতিপক্ষ শিবিরে।
মূলত ২০০৩ সালে টেস্ট অভিষেক হলেও এর তিন বছর আগেই সাদা পোশাক গায়ে জড়ানো হয়ে যায় রাজিনের। সেটি ছিল এক ঐতিহাসিক ম্যাচ। সেটি ছিল ক্রিকেট ইতিহাসে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচ। ২০০০ সালে ভারতের বিপক্ষে সে ম্যাচে দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে দলে ছিলেন রাজিন সালেহ। বিকল্প ফিল্ডার হিসেবে ম্যাচে ফিল্ডিংও করেছিলেন। শর্ট লেগে দাঁড়িয়ে নিয়েছিলেন শচীন টেন্ডুলকারের মূল্যবান ক্যাচ।
সে ম্যাচের পর মূল একাদশে ঠাঁই পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয় আরও তিন বছর। অবশেষে ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ে পাকিস্তান সফরের মধ্য দিয়ে। সেখানেই নিজেকে মেলে ধরেন তিনি। অভিষেক টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেই পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতক। সেই সাথে টেস্ট ক্রিকেটে কিভাবে ধৈর্য্য নিয়ে উইকেটে পড়ে থাকতে হয় তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও স্থাপন করেন দলের মাঝে।
রাজিন সালেহ দেশ সেরা কোন স্ট্রাইকার ছিলেন না। এমনকি দেশ সেরা স্ট্রাইকারদের লম্বা তালিকায়ও তাঁর নাম পাওয়া যাবে না। কিন্তু বাইশ গজে তাঁর যে ব্যাটিং দৃঢ়তা তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ব্যাটিংয়ের সময় কখনোই মেজাজ হারাতেন না তিনি। সাবলীল ব্যাটিংই ছিল তাঁর চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য। এর জন্য নিজস্ব একটি কৌশল ছিল তাঁর। সেটি হল ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাট হাতে উইকেটে যত বেশি টিকে থাকা যায়। এমনকি বলের আঘাত শরীরে নিয়েও সে কৌশল থেকে বিন্দুমাত্র নড়চড় হতেন না তিনি। এই একাগ্রতাই লম্বা পরিসরের ক্রিকেটে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাটিং করতে সাহায্য করত তাঁকে।
এ ধরনের ধীরলয়ে ব্যাটিংয়ের জন্য অবশ্য দর্শক পরিমন্ডলে খুব বেশি জনপ্রিয় ছিলেন না রাজিন। যে কারণে ক্রিকেটার হিসেবে যে গ্ল্যামার তা কখনোই ছুঁয়ে যায়নি তাকে। তাঁর ঠুকঠুক ব্যাটিং অনেকের জন্যই ছিল চোখের বিষ। কিন্তু সে বিষই সমর্থকদের কখনও কখনও অমৃত সুধা হিসেবে পান করতে বাধ্য করতেন রাজিন।
এই যেমন কচ্ছপ গতির ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোন টেস্ট ম্যাচ জয়ে অবদান রাখেন তিনি। ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সে ম্যাচে হাবিবুল বাশারকে সঙ্গে নিয়ে দলীয় স্কোরবোর্ডে ১১৯ রান যোগ করে বাংলাদেশকে প্রথম ইনিংসে ৩১২ রান টপকে লিড নিতে সাহায্য করেন তিনি যা ছিল সে সময়কার প্রেক্ষাপটে খুবই বিরল ঘটনা। ২৩৪ মিনিট উইকেটে ব্যয় করে ১৮২ বলে খেলেন ৮৯ রানের কার্যকরী একটি ইনিংস। আবার বাংলাদেশের প্রথম কোন টেস্ট সিরিজ হিসেবে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এ সিরিজটি জয়েও অবদান রাখে রাজিনের শম্বুক গতির ব্যাটিং।
সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে জয় পেতে মরিয়া জিম্বাবুয়ের দেয়া ৩৭৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে ২০৬ রানের মধ্যে অর্ধেক উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে যায় বাংলাদেশ। সে সময় রাজিনের ঠুকঠুক ব্যাটিংই ম্যাচটি বাঁচাতে ও পরবর্তীতে সিরিজটি জিততে সাহায্য করে বাংলাদেশকে। সেদিন ১৪০ বলে ৫৬ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন রাজিন। পঞ্চম দিনের শেষ সেশনে খালেদ মাসুদকে নিয়ে উইকেটে পার করেন ২২ ওভার। সেই সাথে ম্যাচটি ড্র করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ।
ব্যক্তিগতভাবে টেস্ট ক্রিকেটটা প্রিয় হলেও রাজিন সালেহ ক্যারিয়ারের একমাত্র সেঞ্চুরিটা পান ওয়ানডেতে। ২০০৬ সালে ফতুল্লায় ১১৩ বলে ১০৮ রানের হার না মানা ইনিংসটি খেলেন তিনি কেনিয়ার বিপক্ষে। তারপর ২০০৭ বিশ্বকাপে দলের সাথে থাকলেও কোন ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। বিশ্বকাপের পর মাত্র ৭টি টেস্ট ম্যাচ খেলেন যেখানে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একটি অর্ধশতক রয়েছে তাঁর। টেস্টে টানা বাজে পারফরম্যান্সের দরুণ ২০০৮ এ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে সেই যে বাদ পড়েন তারপর আর দলে ফেরা হয়নি রাজিনের।
মাত্র ২৪টি টেস্ট ও ৪৩টি ওয়ানডে খেলেই থেমে যায় তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের চাকা। টেস্টে ২৫.৯৩ গড়ে রান সংখ্যা ১১৪১ ও ওয়ানডেতে ১০০৫! ঝুলিতে রয়েছে ৭টি টেস্ট ও ৬টি ওয়ানডে ফিফটি এবং ১টি ওয়ানডে সেঞ্চুরি। টেস্টে রাজিন সালেহর পরিসংখ্যানটা আরও ভাল হতে পারত যদি না উইকেটে থিতু হয়েও বার বার আউট হতেন তিনি। ২৪ টি ম্যাচের মধ্যে ৮টিতে তাঁর ৪০ এর ঘরে আউট হবার পরিসংখ্যান সে সাক্ষ্যই দিচ্ছে।
মাত্র ৫ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এক সময় একটি বিরল রেকর্ডের মালিক বনে যান রাজিন যা দীর্ঘ ১৪ বছর পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। ২০০৪ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দলের নিয়মিত অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের ইনজুরিতে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পান তিনি। মাত্র ২০ বছর ২৯৭ দিন বয়সে অধিনায়কত্ব করে সে সময় ওয়ানডেতে সর্বকনিষ্ঠ অধিনায়কের রেকর্ড গড়েন রাজিন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে উইন্ডিজের বিপক্ষে মাত্র ১৯ বছর ১৬৫ দিন বয়সে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করে সে রেকর্ড ভাঙেন আফগানিস্তানের রশিদ খান।
খেলোয়াড়ি জীবনে ফিটনেসকে সবসময় গুরুত্ব দিয়েছেন রাজিন সালেহ। তাঁর সময়ে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা ফিটনেস নিয়ে তেমন কেউ সচেতন ছিলেন না। ফিটনেস নিয়ে কেউ তেমন কাজও করতেন না। কিন্তু ফিটনেসের ব্যাপারে একচুলও ছাড় দিতেন না তিনি। এমনকি খালেদ মাসুদের মত বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকার জন্য সর্বোৎকৃষ্ট ফিটনেসের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সব সময় পরামর্শ দিতেন রাজিন।
তিনি ছিলেন শারীরিকভাবে বেশ সক্রিয় এবং মাঠে ফিল্ডিংয়ের সময় কখনও চিতার গতিতে দৌঁড়ে বাউন্ডারি বাঁচাতেন আবার কখনও চিলের থাবায় লুফে নিতেন দৃষ্টিনন্দন সব ক্যাচ। মূলত এ ফিটনেসের কারণেই জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পরেও দীর্ঘ ১০ বছর টানা খেলে গিয়েছেন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে বাকিটা সময় কাটানো রাজিন। সেই যাত্রার ইতি ঘটেছে ২০১৮ সালে।
খেলা ছাড়ার পর ভবিষ্যত পরিকল্পনামাফিক কাজটা চালুই আছে রাজিনের। মাঠের ছেলে মাঠেই কাজ করে যাচ্ছেন। কাজ করেন দেশের ক্রিকেটের জন্য। সিলেটে ক্লেমন সুরমা ক্রিকেট অ্যাকাডেমি নামে নিজের একটি অ্যাকাডেমি রয়েছে রাজিনের। তাঁর হাত ধরেই হয়তো সিলেটের আগামী প্রজন্ম লড়াই করাটা শিখে ফেলবে।