আশাজাগানিয়া এক আক্ষেপ!

বাংলাদেশ ক্রিকেটে পাওয়ার হিটারের অভাবটা লম্বা সময় ধরেই। অনায়াসে বলকে বাউন্ডারি ছাড়ার করার সামর্থ্যটা গুটি কয়েক ক্রিকেটারের আছে। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তাই বেশ পিছিয়ে তামিম-মুশফিকরা। সাম্প্রতিক সময়ে রঙিন পোশাকে অনেকটাই উজ্জ্বল বাংলাদেশ দল।

তবে, ৮-১০ বছর আগে পাওয়ার হিটিং দূর্বলতার কারণে প্রায় ম্যাচেই ভুগতে হত বাংলাদেশকে। বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে শক্তি-সামর্থ্যের দিক থেকে অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ পিছিয়ে ছিল দলটি। আর তখনই এই ঘাটতি পূরণের সম্ভাবনা দেখিয়ে জাতীয় দলে এসেছিলেন জিয়াউর রহমান।

পেশি শক্তির কারণে বড় বড় ছক্কা হাঁকানোর সক্ষমতা ছিল জিয়ার মাঝে। ক্যারিয়ারের শুরুতে সেটি দেখিয়েই জাতীয় দলে এসেছিলেন। অন্তত টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে একজন ফিনিশার পাচ্ছে বাংলাদেশ। জিয়াকে দিয়ে পাওয়ার হিটিং দূর্বলতার ঘাটতি অন্তত কিছু লাঘব হবে এমনটাই ছিল আশা।

কিন্তু, বলের লাইন-লেন্থ না মেপেই অযাচিত শট খেলতে যাওয়া, টেম্পারমেন্ট সমস্যার কারণেই দীর্ঘ হতে পারেনি জিয়াউরের ক্যারিয়ার। যে সম্ভাবনার আলো দেখিয়ে জাতীয় দলে এসেছিলেন তা নিভে গেছে অল্পতেই!

ক্যারিয়ারের শুরুতে ছিলেন একজন পেসার। শেষদিকে নেমে বাউন্ডারি হাঁকাতে পারতেন। তবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকের পর হাঁটুর ইনজুরিতে বদলে যায় সব। পেসার থেকে বনে যান মিডিয়াম পেসার হিসেবে। সেই সাথে পাওয়ার হিটিং সামর্থ্যের কারণে মনযোগী হন ব্যাটিংয়ে। লোয়ার অর্ডারে কার্যকরী অলরাউন্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন জিয়াউর।

খুলনার বেদবুনিয়া গ্রামে জন্ম জিয়াউরের। গ্রামের লোকাল লিগে খেলেই নিজের সামর্থ্য টের পান এই অলরাউন্ডার। ক্রিকেটার হবার নেশায় মত্ত হয়ে ছুঁটে আসেন ঢাকায়। বেশ কয়েক বছর বয়সভিত্তিক দলে পেসার হিসেবে খেললেন। সেখান থেকেই জায়গা করে নিলেন অনূর্ধ্ব -১৯ দলে। সেখান থেকে জাতীয় লিগে (এনসিএল) খুলনা ডিভিশনের হয়ে খেলার সুযোগ পান তিনি।

২০০৫ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট অভিষেক মৌসুমে নেন ১৮ উইকেট! পরের মৌসুমে শিকার করেন ৩০ উইকেট। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে দুই মৌসুমে খুলনার হয়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন জিয়াউর। এরপর ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের স্কোয়াডে জায়গা করে নেন তিনি। কিন্তু তখন তিনি মূলত একজন পেসার হিসেবেই জায়গা পেয়েছিলেন। যদিও কোনো ম্যাচেই সুযোগ পাননি এই পেসার।

তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স অব্যহত রাখেন এই পেসার। ২০০৮-০৯ মৌসুমে শিকার করেন ৩৮ উইকেট! এরপর সেই হাঁটুর ইনজুরিতে লম্বা সময় ছিটকে যান ক্রিকেট থেকে। পেসার থেকে শুরু করলেন মিডিয়াম পেস বোলিং।

কিন্তু, ব্যাটিং সামর্থ্যের কারণে মূলত সুযোগ পেলেন ঢাকা লিগে! ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে (ডিপিএল) ওল্ড ডিওএইচএস এর হয়ে ও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) সুযোগ পেলেন চট্রগ্রাম কিংসের হয়ে। তখন তিনি পেসার থেকে একজন ব্যাটার; যিনি মাঝে মাঝে মিডিয়াম পেস বোলিংটা করতেন।

এরপর ব্যাট হাতেই নিজের সেরাটা দিয়ে উঠে এসেছিলেন জাতীয় দলে। বিপিএলে পাওয়ার হিটিং সামর্থ্য দেখিয়ে নজর কেঁড়েছিলেন সবার। ২০১২ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয় জিয়াউরের।

রঙিন পোশাকে পাওয়ারপ্লেতে দ্রুত রান তোলার জন্য টপ অর্ডারে সুযোগ পান জিয়াউর। সেন্ট্রাল জোনের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগে (বিসিএল) দেখা পান প্রথম সেঞ্চুরির। ১৪৩ বলে ১৫২ রানের বিধ্বংসী ইনিংসে তিনি ১৫ ছক্কা হাঁকান!

এরপর ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষেক হয় জিয়ার। একই বছর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক! ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে তখন নিয়মিত মুখ হলেও টেস্ট অভিষেক এক ইনিংসে ৪ উইকেট শিকারের পরেও দল থেকে বাদ পড়েন! সাদা পোশাকের ভ্রমণটা মাত্র এক টেস্টেই সীমাবদ্ধ ছিল।

ওয়ানডে অভিষেকের পর প্রথম দুই বছর দলে অনেকটাই নিয়মিত ছিলেন জিয়াউর। খেলেছেন ১৩ ম্যাচ। মাত্র ১১ গড়ে করেছেন ১২৪ রান! বল হাতে ৪.৬৩ ইকোনমিতে শিকার করেছেন মাত্র ১০ উইকেট! ব্যাটার জিয়াউরকে জাতীয় দলের জার্সিতে আর পাওয়া গেল না। বল হাতেও ছিলেন একেবারে সাদামাটা।

টি-টোয়েন্টিতে খেলেছেন ১৪ ম্যাচ। ১২৯ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করলেও মাত্র ১৩ গড়ে করেছেন ১১৭ রান! বল হাতে ৪২ গড় আর ১০ এর বেশি ইকোনমিতে মাত্র ৩ উইকেট! ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্স কিংবা ধারাবাহিকতা কিছুই ধরে রাখতে পারেননি জাতীয় দলের জার্সিতে। আর তাই অল্পতেই থমকে যায় জিয়াউরের ক্যারিয়ার।

২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরই বাদ পড়েন দল থেকে। এরপর আর জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি তিনি। বয়সটা এখন ৩৫-৩৬! জাতীয় দলে ফেরার আর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যদিও ঘরোয়া ক্রিকেটে এখনও প্রায়ই ব্যাটে-বলে পারফরম করছেন নজরকাঁড়া।

বাংলাদেশ দলের জন্য না হলেও তিনি নিজেই নিজের জন্য এক আক্ষেপ! এক হাঁটুর ইনজুরি যেন পাল্টে দিয়েছে জিয়ার জীবনের পথ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link