অধিনায়ক যিনি ‘যথেষ্ট’ ছিলেন না

হয়তো তিনি নায়কোচিত কোনো অধিনায়ক ছিলেন না। কিন্তু, তার মানে এই নয় যে – তিনি যথেষ্ট রকমের সাহসী ছিলেন না। ইংল্যান্ডের সদ্য বিদায়ী টেস্ট অধিনায়ক জো রুটের অধিনায়কত্বকে যেন এই দুটি লাইনের চেয়ে ভাল ভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, কোনো ভাবে।

পাঁচ বছরের মত সময় – খুব কম নয়। আবার খুব বেশিও নয়। রুট এমন একটা সময়ে ইংল্যান্ডের অধিনায়কত্ব নিয়েছিলেন, যখন বিরাট একটা ইংলিশ টেস্ট সাম্রাজ্য রীতিমত ধুঁকছে। রুট অনেক কিছুই করেছেন, ব্যাটিং অর্ডার পাল্টেছেন, বোলারদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। কিন্তু, ‍কোনোটাই যেন ইংল্যান্ডের পতন ঠেকাতে যথেষ্ট হয়নি।

মহানায়ক অ্যালিস্টেয়ার কুক যখন বিদায় বলেছিলেন অধিনায়কত্বকে, তখন একজনই উপযুক্ত কিংবা উপযুক্তের কাছাকাছি ছিলেন সেই দায়িত্বের। তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং জো রুট। দলের অন্যতম সেরা ব্যাটারের মধ্যেই ভবিষ্যতের কান্ডারি খুঁজে নিতে চেয়েছিল ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি)। আর সেই সময়টাতে ক্যারিয়ারের অন্যতম সুদিনই কাটাচ্ছিলেন রুট।

যদিও, অধিনায়কত্বের সময়টা তাঁর জন্য ছিল অম্লমধুর। তাঁর অধীনে ইংল্যান্ড কখনোই দলের সঠিক কম্বিনেশন খুঁজে পায়নি। পায়নি সঠিক দিশা। আর শুনতে খারাপ শোনালেও একই সাথে এটাও ঠিক যে, রুটও ঠিক কখনো ইংল্যান্ড দলকে সঠিক পথের দিশা দেখাতে পারেননি।

আর এই প্রক্রিয়ায় রুট অদ্ভুত এক রেকর্ডের মালিক বনে গেছেন। তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে একই সাথে সবচেয়ে বেশি টেস্ট জয়ের অধিনায়ক যেমন, তেমনি অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি টেস্ট হারের কালিমাও সঙ্গী হয়েছে তাঁর। সর্বশেষ ভারতের বিপক্ষে হেডিংলি টেস্ট দিয়ে তিনি মাইকেল ভনের অধিনায় হিসেবে ২৬ টি টেস্ট জয়ের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছেন। আবার অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুর্ভাগ্যজনক এক শীতকালে তিনি কুকের সবচেয়ে বেশি হারের রেকর্ডেও ভাগ বসিয়েছেন।

রুট অবশ্য ব্যক্তিগত অর্জনে রীতিমত ইংলিশ অধিনায়কদের মাস্টার। ব্রিটিশ অধনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি রান, সবচেয়ে বেশি শতক ও অর্ধশতক, সবচেয়ে বেশি ক্যাচ – সবই তাঁর দখলে। এমনকি অধিনায়ক হিসেবে ইংল্যান্ডের অষ্টম সর্বোচ্চ উইকেটও তিনিই শিকার করেছেন পার্টটাইম স্পিন দিয়ে। আরেকটা বছর দায়িত্বে থাকলে হয়তো সবার ওপরেই উঠতেন, অন্তত একটা ভারত সফর পেয়ে গেলে তো কথাই নেই।

রুটের থেকে বেশি টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে হেরেছেন ইতিহাসে আর মাত্র দু’জনই। তারা হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথ ও নিউজিল্যান্ডের স্টিফেন ফ্লেমিং। স্মিথ ১০৯ টেস্টে ২৯ টি  ও ফ্লেমিং ৮০ টি টেস্টে ২৭ টি ম্যাচ হেরেছেন। দু’জনই নিজ নিজ দেশের ইতিহাসের সেরা অধিনায়কের তকমা পান। তাহলে কী রুটকে ইচ্ছা করে আন্ডাররেট করা হচ্ছে?

রুট ২৬ টি ম্যাচ হেরেছেন ৬৪ টি টেস্ট খেলে। সমস্যা হল সর্বশেষ ১৭ টি ম্যাচে ইংল্যান্ড জিতেছে মাত্র একটি ম্যাচে। এটাই যেন রুটকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে – তুমি চলনসই ছিলে বটে, তবে যথেষ্ট ভাল ছিলে না।

রুটের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব নিশ্চয়ই বেন স্টোকস। এই রুটের জমানাতেই অলরাউন্ডার হিসেবে বিকশিত হয়েছেন স্টোকস। নেতার চেয়ে অনেক বেশি বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন রুট। মানসিক অবসাদগ্রস্থ স্টোকসের সাময়িক সরে দাঁড়ানোতেও মানবিকই ছিলেন রুট। সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘শুধু চাইবো আমার বন্ধুটি যেন ভাল থাকে।’

ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থের ‍উর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন বটে, তবে দল পড়ে গিয়েছিল জটিল এক পরিস্থিতিতে। বিশেষ করে বোলারদের ভূমিকা পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে। ইনজুরিগ্রস্থ জোফরা আর্চারকে আদৌ টেস্ট ক্রিকেটে অধিনায়ক রুট ব্যবহার করতে পারেননি। একই কথা জ্যাক লিচের ক্ষেত্রেও খাটে। তবে, এটা ঠিক যে দুই অভিজ্ঞ পেসার স্টুয়ার্ট ব্রড ও জেমস অ্যান্ডারসনের শতভাগ সমর্থন ও শক্তিটা পেয়ে গেছেন রুট। তবে, এই দু’জনের বিকল্প তেমন একটা গড়ে ওঠেনি।

সব মিলিয়ে রুট ভাল মানুষই ছিলেন ড্রেসিংরুমে। ব্রড যেমনটা বলেন, ‘সর্বোচ্চ সংখ্যক টেস্ট জয়ী ইংলিশ অধিনায়ক ও একজন ভাল মানুষ।’ হ্যাঁ, ইংল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশি টেস্ট জয়ের পরও তিনি ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সেরা অধিনায়ক নন – এটাই রুটের অধিনায়কত্বের সবচেয়ে বড় ক্রাইসিস। তিনি ভাল ছিলেন, কিন্তু যথেষ্ট ভাল ছিলেন না কখনোই।

কী করলে ভাল হত? – হয়তো ক্যারিয়ার জুড়েই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবেন না রুট। মনে মনে নিজেকে দূর্ভাগা মানা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তাঁর!

 

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link