মার্সেলো ভিয়েরা এসেছিল ব্রাজিলের ফ্লুমিনেস থেকে। সে অনেক বছর আগের কথা। তখনও পরিবর্তন আসেনি। উঠতি তরুণ প্রতিভা হিসেবে ইউরোপের দুটো দেশে লড়ছে দুই তরুণ। রিয়াল মাদ্রিদে মার্সেলোর আগমন সেই সময়ের ইতিবৃত্ত। এবং অবশ্যই ইতিবাচক।
এতদিন ধরে যে রোলটা মাঠে প্লে করেছেন কিংবদন্তী রবার্তো কার্লোস, তারই স্বদেশীয় এবং সেই একই পজেশন – প্রবাদপ্রতিম হবে, দিকপাল হবে এসব কথা কেরিয়ারের শুরুতে কেউই কখনও ভাবেনা, লস ব্ল্যাঙ্কোসের সমর্থকরাও ভাবেননি। ভাবেননি, লিডার অফ মেন হতে এসেছে ঐ টাকমাথা মার্সেলো ভিয়েরা, গড়পড়তা হতে নয়।
৩৫ তম লা লিগা ট্রফি হাতে যে লোকটা উঠল, সে ততদিনে প্রবাদে পরিণত হয়ে গেছে তার বাঁ পায়ে রিসিভিংয়ের জন্য। অত উঁচু লং বলকে অবাক করে বাঁ পায়ে স্টপ করানোর যে ভঙ্গিটা গত এক দশক ধরে মার্সেলো দেখিয়ে এল ফুটবল বিশ্বকে।
চারবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগকে ছোঁয়ার দুর্দমনীয় গর্ব রয়েছে তার পকেটে। রিয়াল মাদ্রিদের পরবর্তী সেরা সময়ের কাণ্ডারীও মার্সেলো। এ হেন পরিস্থিতিতে টিম একত্রে ট্রফি নেওয়ার লোক হিসেবে এগিয়ে দিল ঐ মার্সেলোকেই। কেরিয়ারের অন্তিম লগ্নে এ জাতীয় সম্মান বোধহয় মার্সেলোই ডিজার্ভ করে। ‘আপনি’ শব্দটা ইচ্ছে করেই উহ্য রাখা, কারণ মার্সেলোকে কখনও দূরের তারা বলে মনে হয় না।
সেই মার্সেলো মাদ্রিদের রাজপথে চোখধাঁধানো সেলিব্রেশনে, হাজার হাজার সমর্থকের মাঝে প্লাজা দে সিবেলসে উঠে স্কার্ফ বাঁধলেন। প্লাজা দে সিবেলস্— রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থক এবং টিম ম্যানেজমেন্টের সেলিব্রেশনের প্রথম এবং আদি ধাপ। যে কোনও ট্রফি হোক, ছোট-বড়-মাঝারি, সেলিব্রেশনের প্রথম গন্তব্যই ঐ সিবেলসের ফোয়ারা।
যা মাদ্রিদের গর্ব, মাদ্রিদ শহরের একটি দুর্মূল্য অলঙ্কার। এর নেপথ্য কাহিনী বেশ ইন্টারেস্টিং। দেবীর রথের সামনে যে সিংহদ্বয় বসে, তারা কেউ একে অপরের দিকে তাকায় না। কথিত, আসলে নাকি ওরা দু’জন প্রথমত সিংহ নয়ই। আদতে দু’জন – দেবী আটালান্টা এবং দেবতা হিপোমেনেস।
প্রেমের প্রতীক এরা। আটালান্টা কখনও চায়নি বিয়ে-টিয়ে করতে। সিঙ্গেল লাইফ ইস দ্য বেস্ট— এই মূলমন্ত্রে জীবন কাটাতে চেয়েছেন যখন, তখন তাঁর রূপ এবং গুণে মন্ত্রমুগ্ধ হচ্ছে আপামর দেবতাগণ। বিয়েতে অনিচ্ছুক আটালান্টা শর্ত রাখেন দৌড়ে তাঁকে পরাজিত করতে হবে। যে পুরুষ পারবে, তাঁকেই তিনি বিয়ে করবেন এবং যদি তিনি পরাজিত হন, তবে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুদণ্ড!
এমতাবস্থায় এগিয়ে এলেন হিপোমেনেস। তুখোড় বুদ্ধিমান পুরুষ। তিনি জানেন আটালান্টাকে নর্মাল দৌড়ে কখনওই পরাজিত করা সম্ভব নয় কারণ আটালান্টার স্পিড ছিল মারাত্মক। শুধু তাই নয় শিকারী হিসেবেও আটালান্টার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। কিন্তু, একটা উপায়ে সম্ভব। সেটা হল, আটালান্টার একটা বদ গুণ— লোভ। দেবী আফ্রোদিতার শরণাপন্ন হলেন তিনি। চেয়ে নিলেন তিনটি সোনার আপেল।
এবার যখন দৌড় শুরু হল, ট্র্যাকের বহু দূরে একটা সোনার আপেল হিপোমেনেস ছুঁড়ে ফেললেন। আটালান্টা যখন সেটা দেখতে দেখতে নিজের স্পিড কমিয়ে ফেলল, তখন হিপোমেনেস তাঁকে ক্রস করে অনেকটা দূরে চলে গেলেন। এইভাবে তিনটি আপেলের মাধ্যমে বা বলা ভাল কারসাজিতে, রেসটা হিপোমেনেস জিতলেন। সঙ্গে জিতলেন আটালান্টার কোমল হৃদয়। পরিণয়বদ্ধ হলেন দু’জনায়।
কিন্তু এর পরেই ট্র্যাজিক! একদা শিকার করতে গিয়ে দু’জনে নিজেদের একান্ত হওয়ার জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। নিরুপায় হয়ে তাঁরা এক মন্দিরে ঢুকলেন এবং সেই সময় আচমকা তুমুল ঝড়বৃষ্টি শুরু হল। তাঁরা আর নিজেদের রোধ করতে পারলেন না, ডুবে গেলেন প্রেমের অতল সমুদ্রে। আর এটাই কাল হল!
শাস্তিস্বরূপ দু’জনকে অভিশাপ দেওয়া হল, তাঁরা সিংহরূপে দেবীর রথ টানবেন কিন্তু জীবনেও কেউ কারোর দিকে তাকাতে পারবেন না। আজও স্কাল্পচারে ঠিক ঐভাবেই দুই সিংহ দু’মুখো হয়ে বসে থাকে, আর গোটা ভাস্কর্যের ঠিক পেছনে ধরা থেকে গেছে আটালান্টা আর হিপোমেনেসের প্রেমের দুরন্ত কাহিনীর স্বরূপ, যাদের স্পেনের রাজা তৃতীয় কার্লোস ভাস্কর্যে পরিণত করলেন অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে। সৌজন্যে, স্পেনের বিখ্যাত স্কাল্পচারার ফ্রান্সিসকো গুতিয়েরেজ।
তার বহু বছর পর, ১৯৮০ থেকে রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাব সমর্থকগণ মাদ্রিদের এই প্রতীকের সামনে উদযাপনের বিলাস করে। অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদও সিবেলস্ ফাউন্টেনেই তাদের ট্রফি জয়ের সেলিব্রেশন করত, কিন্তু একবার ঘটনাচক্রে তারা সেলিব্রেট করতে ছোটে অদূরেই নেপচুনো ফোয়ারায়। সেই থেকের অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের সেলিব্রেশনের প্রতীক নেপচুনো ফাউন্টেন!
সেই সিবেলসে একদা বাচ্ছা এবং এখন মাদ্রিদ কিংবদন্তী মার্সেলো ফুটবল জীবনের অন্তিম লগ্নে অধিনায়ক হিসেবে স্ট্যাচুর গলায় স্কার্ফ বেঁধে এল। এ অন্য সম্মান, অন্য এফেক্ট। মাদ্রিদের একনায়ক মার্সেলো এবার বাকি জীবনটা শুধু স্বপ্নালু হয়েই কাটাতে পারেন, ট্রফির ভীড়ে আর তাকে দেখা যাবে না, এই আফসোসটা মাদ্রিদ সমর্থকরা বুকে এঁকে নিয়েই এগিয়ে যাবেন আগামী সূর্যের আহ্বানে।