ইয়ান বিশপ একবার বলেছিলেন, ‘লিটন যখন ব্যাট করে, মনে হয় মোনালিসার মত কোনো চিত্রকর্ম দেখছি।’ ইয়ান বিশপই নয় শুধু, হার্শা ভোগলে এর মত ক্রিকেট এক্সপার্টও লিটন দাসের ব্যাটিংয়ের চরমভক্ত। অনূর্ধ্ব ১৯ থেকেই দ্যূতি ছড়িয়েছে লিটনের ব্যাট থেকে। এরপর ঘরোয়া ক্রিকেটে রীতিমতো রান বন্যা বইয়ে এসেছেন জাতীয় দলে। অবশ্য রান সংখ্যা নয়, তার রান সংগ্রহের নান্দনিকতাই দেশে বিদেশে লিটনের অসংখ্য ব্যাটিংভক্ত সৃষ্টি করেছে।
সামনের পায়ে ভর করে পুল, কাভার ড্রাইভ, স্ট্রেইট ড্রাইভ কিংবা স্কয়ার কাট অথবা ফ্লিক! যেই শটটার কথাই আপনার মাথায় আসবে লিটন তাই করে দেখাবে, সবচেয়ে সাবলীল আর সুন্দর উপায়ে। এই যখনই ছন্দে থাকা লিটন কোন শট খেলেন, একেবারে কপিবুক শট খেলেন, মনে হয় শটগুলো অথেনটিক। বাইশ গজে একবার সেট হয়ে যাওয়া লিটন হয়তো দর্শকের সবচেয়ে বড় বিনোদন আর প্রতিপক্ষের দুঃস্বপ্ন।
আজকের কথাই বলা যাক, ব্যাট করতে যখন এসেছিলেন বাংলাদেশ তখন মাত্র ২৪ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল। রয়ে সয়ে লিটন নিজেকে মানিয়ে নিলেন, সেট হয়ে উঠলেন বাইশ গজে। এরপর একেবারে নিঁখুত ব্যাটিং প্রদশর্নী দেখা গেলো শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে। শ্রীলঙ্কার সুইং আর গতি দুইটাই দারুণভাবে সামলেছেন।
ভাল ডেলিভারিগুলোকে দিয়েছেন যথাযথ সম্মান তেমনি বাজে বলগুলোকে মাঠছাড়া করতে হাত কাঁপেনি একটুও। এরপর লিটন তুলে নিয়েছেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। কি ভীষণ চাপের মুখে পাওয়া সেই সেঞ্চুরি সেটা তো আগেই বলা হল। টেস্ট ক্যারিয়ারের তৃতীয় সেঞ্চুরি।
ক্রিকেট বিধাতা লিটনকে অনেক দিয়েছেন, দেননি ধারাবাহিকতা – এমন একটা সমালোচনা হয় প্রায়। ক্রিকেটের মাঠে যে শিল্প প্রদর্শন করেন লিটন দাস, তাই যেন অনিয়মিত – এই কথা বলার লোকের অভাব হয় না। হ্যাঁ, অভিষেকের পর থেকে চার পাঁচ বছর পর্যন্ত লিটন যেমন খেলেছেন তাতে এমন সমালোচনা যৌক্তিক। তবে, বর্তমান বাস্তবতায় কথাটা ধোপে টিকবে না।
চলতি শ্রীলঙ্কা সিরিজেই প্রথম টেস্টে করেছিলেন ৮৮ রান; দ্বিতীয় টেস্টে দলের ব্যাটিং বিপর্যয়ে শক্ত হাতে হাল ধরেছেন, মুশফিকুর রহিমের সাথে সময়োপযোগী একটি জুটি গড়েছেন। শুধু তাই নয়, ২০২২ সালের আন্তজার্তিক ক্রিকেটে লিটনের চেয়ে বেশি রান করতে পারেননি বাবর আজম, বিরাট কোহলি’রাও। ইতোমধ্যে ৮০০ এর বেশি রান করেছেন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। ২০২১ সাল থেকে লিটন যেভাবে রানে ফিরেছেন তাতে তাকে আর অধারাবাহিক বলার সুযোগ কই।
অবশ্য টেস্টে লিটন দাসের অর্ধশতককে শতকে রূপান্তরের হার একটু আক্ষেপ করার মত বটে। তিনটি শতকের বিপরীতে ১২ টি ফিফটি; বেশ কয়েকবার তিন অঙ্কের কাছাকাছি করে ফিরতে হয়েছিল। লিটন দাস এখন হাফসেঞ্চুরি করলেও সন্তুষ্ট হয় না ভক্তরা, প্রত্যাশার পারদটা এতটা উপরে নেয়ার পুরো কৃতিত্ব লিটনেরই।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ট্রলের শিকার হওয়া ক্রিকেটার এখন দেশের সবচেয়ে ইন ফর্ম ব্যাটসম্যান। এমনকি বর্তমান বিশ্বের সেরা উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান বললেও আপত্তি থাকার কথা নয় কারো। লাল বলে লিটন দাস গত দুইবছর ধরেই উড়ন্ত ফর্মে। সাদা বলেও এমন ফর্ম ধরে রাখতে পেরেছেন তিনি।
ওয়ানডে ফরম্যাটে ইনিংসের শুরুতে কিংবা টেস্টে মিডল অর্ডারে যেখানেই খেলতে নেমেছেন দায়িত্ব নিয়ে ব্যাটিং করেছেন লিটন। লিটনকে একসময় বলা হতো ব্যাট হাতে অধারাবাহিক একজন পাবলো পিকাসো। তবে লিটন শেষ পর্যন্ত নিজের অবিশ্বাস্য প্রতিভা মাঠে কাজে লাগাতে পেরেছেন। আর তাই বলতে হয়, পিকাসো’র ব্যাট এখন ধারাবাহিক ও ধারালো।