কেবল রোহিত শর্মার অধিনায়কত্ব? কেবল মুম্বাইয়ের পাঁচ শিরোপা জয়? না, আইপিএলের শিক্ষাটা একেবারেই ভিন্নরকম কিছু।
এই এক আইপিএল ভারতের ক্রিকেট ইতিহাস বদলে দিয়েছে। সেটা শুধু মাঠের খেলায় নয়, মাঠের বাইরের আয়োজনেও।
একটা সাধারণ ব্যাপার থেকে শুরু করা যাক।
ছোটবেলা থেকে যেসব লেজেন্ডারি ক্রিকেটারদের খেলা দেখে বড় হয়েছে এই প্রজন্ম, তাদেরকে হয় কোচিং ডাগ আউটে দেখে যাচ্ছে নয়তো কমেন্ট্রি বক্সে। বিশ্বের সব তারকাকে এভাবে কোচিং স্টাফ, কমেন্টেটর বানিয়ে দেওয়া কিন্তু চাট্টিখানি কথা না মোটেও।
ক্রিকেট খেলা মানে শুধুমাত্র যে মাঠে ১১ জন খেলবে এই কনসেপ্ট থেকে বের হয়ে এসেছে আইপিএল। নিজের ছোটবেলার হিরোকে একনজর দেখা বা তার ভরাট কন্ঠস্বর শুনার জন্যও বহুজন কান পাতে ম্যাচ কমেন্ট্রিতে। আপনি যদি একজন ভিনসেন্ট ক্রিকেটপ্রেমী হয়ে থাকেন তবে এর চেয়ে বড় তৃপ্তি আর কিছুই আপনাকে দিতে পারবেনা – এটা হলফ করে বলা যায় বৈকি।
আবার প্রত্যেক দলের কোচিং স্টাফের সংখ্যা প্লেয়িং ইলেভেন থেকেও বেশি! এবং সবচেয়ে বড় কথা কোনো আগাছা বা কোনোরকমে কাজ চালিয়ে নেওয়ার মত মানুষ না, রীতিমত বাঘা বাঘা তারকার মেলা বসিয়ে রেখেছে। সর্বক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের চুড়ান্ত নমুনার ছাপ রেখে চলেছে এই টুর্নামেন্ট। একটা উদাহরণ দিলে এই ব্যাপারে পরিষ্কার হওয়া যাবে।
সেবার মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স এর হয়ে আমাদের মুস্তাফিজুর রহমান খেলতে গিয়েছিল ভারতের এই টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে। টিমের অধিকাংশ কোচিং স্টাফ ইংরেজিতে দিকনির্দেশনা দিবে কিন্তু ফিজের ইংরেজি বুঝার ক্ষমতা ছিল দুর্বল। ভাষাগত এই জটিলতায় দলের কোনো ক্ষতি না হওয়ার নিমিত্তে বাংলাদেশ থেকে উড়িয়ে নেওয়া হয় নাফিজ ইকবালকে। এর কি আদৌ কোনো দরকার ছিল? ভারতে বাংলাভাষী মানুষ মোটেও কম নয়, মুম্বাই টিমেইতো কলকাতার কিছু প্লেয়ার আছে। তাছাড়া ভাঙা ভাঙা ভাষায় কাজ চালিয়ে নেওয়া যেতো কিন্তু তাদের প্রফেশনাল মানুষ লাগবে, এক্ষেত্রে কোনো ছাড় নয়।
এটাই আইপিএল।
স্মিথ, ভিরাট, ওয়ার্নার, স্টোকস, বাটলার, উইলিয়ামসনরা মাঠের বাইরে কিভাবে মজা,দুষ্টুমি করছে, ভিন্নভাবে অনুশীলন করছে কিনা এসব দেখার প্রচুর ইচ্ছা ফ্যানদের মাঝে আছে। তারা যেহেতু আন্তর্জাতিক তারকা তাই তাদের আবেদন পুরো ক্রিকেট বিশ্বজুড়েই আছে। আইপিএলের প্রত্যেকটা টিম এই বাজার ধরতে মোটেও দেরি করেনি। তাদের আধুনিক সোশ্যাল একাউন্টে প্রতিনিয়ত এসব আপডেট থাকে এবং একাউন্টগুলো তুমুল জনপ্রিয় ভারত ও ভারতের বাইরে।
একবার ভাবুন ইন্ডিয়ান তরুন খেলোয়াড়রা কি ভাগ্যবান! বিশ্বের সেরা সেরা প্লেয়ারদের সাথে ড্রেসিংরুম শেয়ার করছে, কতকিছুই না শিখছে।
আবার বিশ্বসেরা ট্যাকটিশিয়ানদের কাছ থেকে ইন্ডিয়ার স্থানীয় কোচ কত ট্যাকটিকস শিখছে চিন্তা করে দেখুন। নিজেদের নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার এইতো সুযোগ, হেলায় কে সুযোগ হাতছাড়া করবে?
শুধু মাঠের খেলা দেখলেই হবেনা; খেলার পেছনে যে ঝকঝকে গ্রাফিক্স, এনালাইসিস সহ বিশাল কর্মযজ্ঞ চলে তাতেও ভারতীয়রা প্রচুর লাভবান হচ্ছে। একসময় এসব প্রোডাকশন, টেকনোলোজিতে শতভাগ সাদা চামড়ার মানুষের দাপাদাপি ছিল। কালের পরিক্রমায় এখন কিছু কিছু ভারতীয়দের দেখা যাচ্ছে সাদা চামড়ার ফাঁকে। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি প্রয়োগ খাতে শতভাগ ভারতীয় থাকবে এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়।
তাছাড়া বিশ্বকাপের মত সর্বোচ্চ মঞ্চে যেসব আম্পায়ারগণ ক্রিকেট ম্যাচ পরিচালনা করেন তাদের অধিকাংশই আইপিএলে আম্পায়ারিং করছে এবং সাথে থাকছে স্থানীয় কিছু আম্পায়ার। এতে স্থানীয় আম্পায়ারদের কি পরিমান উপকার হচ্ছে, তাদের স্কিল কতটা বাড়ছে- তা সহজেই অনুমেয়।
এভাবেই তো একটা দেশের ক্রিকেট এগিয়ে যায়।
আপনি আইপিএলকে বাজিকরদের খেলা বলে উড়িয়ে দিতে পারেন কিন্তু এই আইপিএলের কল্যাণে পুরো ভারতের ক্রিকেট সেক্টরের গুণগত মান কোন উচ্চতায় উঠে গেছে তা কল্পনাও করা যায় না।
স্পিন নির্ভর একটা দেশে হঠাৎ করেই নিয়মিত ১৪৫ কিমি প্রতি ঘন্টায় ঝড় তোলা কিংবা ডেথ ওভারে ইয়ার্কারের পর ইয়ার্কার করে যাওয়া বোলারের ছড়াছড়ি আপনার কাছে মিরাকল মনে হতে পারে। কিন্তু এটা কোনো মিরাকলই না; এটাই এখন বাস্তবতা!
আইপিএলের মত এত টাকার ঝনঝনানি হয়তো নেই বাংলাদেশের। কিন্তু যা আছে তা কি ছোট করে দেখার সুযোগ আছে? স্পন্সর, ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসা, প্রতিভা, অবকাঠামো, বিশাল মার্কেট যেটা প্রতিনিয়ত বড় হতেই চলেছে-অনেক কিছুই আছে আমাদের?
আইপিএলের মত সেরা হয়ে উঠার সব উপাদান বিপিএলের আছে, শুধুমাত্র বোর্ডের সদিচ্ছা আর আধুনিক মনমানসিকতাই যথেষ্ট। নিয়ে আসতে হবে নতুন নতুন চমক, দেখাতে হবে পেশাদারিত্বের চুড়ান্ত নমুনা, সম্প্রচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। শুধুমাত্র একয়টা জিনিস মাথায় রাখলেই বিপিএল হতে পারে আইপিলের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী, কে জানে হয়তো ছাড়িয়ে যেতে পারে আইপিএলকেও।