স্পর্ধা আমার হাড়ে-মজ্জায়

জর্জ বেস্ট, ডিয়েগো ম্যারাডোনা, শেন ওয়ার্ন, মারিও বালোতেল্লি, ইয়ান বোথাম শোয়েব আখতার – তালিকাটা অনেক লম্বা। এদের ‘ব্যাড বয়’ ইমেজকে আমরা অনেক ফুলিয়ে লিখতে পছন্দ করি। বেস্টের মাতলামি, ওয়ার্নির পাবলিক প্লেসে ধুমপান বা মারিও বালোতেল্লির তেড়ে আসার গল্পগুলো জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়, স্বর্ণাক্ষরেই। আর তাঁদের নারীপ্রীতির কথা তো বাদই দিলাম।

ম্যারাডোনার ফুটবল গুণ তো ছিলই, তার সাথে ছিল বুক ভরা হ্যাডম। ভাল মন্দ পরের কথা, মাঠ ও মাঠের বাইরে নানা রকম কাজে-অকাজে তাকে পাওয়া যেত। সামাজিক ভাবে অনৈতিক হতে পারে, কিন্তু সব মিলিয়ে সেটাই ম্যারাডোনার ইমেজ। সেজন্যই তিনি ফুটবল-ঈশ্বর।

যাদের কথা বলা হল, তাঁরা কেবল মাঠের কীর্তি দিয়েই তাঁরা কীর্তিমান হননি। সাথে যোগ হয়েছিল মাঠের বাইরের অনেক ঘটনা, অনেক আলোচনা। এই ঘটনা বা আলোচনার সব কিছুই যে ইতিবাচক, তা বলা যায় না। অনেক রকম বিতর্ক কিংবা কেলেঙ্কারিও ছুঁয়ে গেছে তাঁদের।

তাঁদের চালচলন, কথাবার্তা, ব্যক্তিগত জীবন, গণমাধ্যম সামলানো – সব কিছু নিয়েই আলাদা আলাদ আলাদা কাব্য রচনা করা যায়। এই ইতিবাচক-নেতিবাচক সব কিছু মিলেই তো তাঁরা তারা বনেছেন। এসব কিছুই তাঁদের সর্বকালের সেরার কাতারে নিয়ে গেছে।

একই রকম কথা কি সাকিব আল হাসানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য নয়? সাকিব মানেই কি মাঠের সব অবিস্মরণীয় কীর্তি? নাকি সাকিব একটা প্যাকেজ? যে প্যাকেজে মাঠের পারফরম্যান্স যেমন আছে, তেমনি আছে মাঠের বাইরের সব কাণ্ড, মজার সব সংবাদ সম্মেলন আর অবিস্মরণীয় এক রূপান্তরের লড়াই।

সাকিব শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। দীর্ঘ সময় সব ফরম্যাটে র‌্যাংকিংয়ে এক নম্বরে থাকার কীর্তি আছে তাঁর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কিংবা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট – সব জায়গাতেই নিজের দিনে তিনি এক নম্বর – ফলে এখানে তাঁকে নিয়ে বাড়তি কথা বলাটা রীতিমত বাহুল্যতা।

এবারে আসি তাঁর মাঠের বাইরের জীবনে। না, সাকিবের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনো সমালোচনা নেই। তিনি পরিপূর্ণ একজন ফ্যামিলি ম্যান। তবে, তিনি নিজের খেয়ালের রাজা। আজ তিনি মাঠে, কাল তিনি কোনো বিজ্ঞাপনের শ্যুটিংয়ে।

আজ খেলছেন, কাল হয়তো ছুটি নিয়ে আমেরিকায় চলে যাবেন পরিবারের কাছে। কখনও  অফিসিয়াল ফটোসেশনে থাকবেন, কখনও বা থাকবেন না। কখনও ডাক মারবেন, কখনও এমন এক আনপ্লেয়েবল ডেলিভারি করবেন, যা বোঝা কঠিন – কখন কি যে করবেন আসলে বলা মুশকিল!

সাকিবের এই ভিন্ন ঘরানারা বৈচিত্রময় চরিত্র নিয়ে আমরা আলোচনার চেয়ে সমালোচনাই বেশি করি। অথচ, আমরাই আবার ওয়ার্ন, বোথাম বা ম্যারাডোনাদের নিয়ে মহাকাব্য লিখি। সাকিবকে নিয়ে লিখতে গিয়ে নানারকম যদি, কিন্তু রেখে দেই! জেসি রাইডার কি এমন মহা গ্রেট ব্যাটসম্যান! তাকে নিয়েও তো প্রচুর লেখা হচ্ছে। সাকিবের ইনোসেন্ট চেহারার জন্যই কি তাকে নিয়ে সেরকম লেখা যায় না? কারণ কি?

কারণ হল, আমরা সাকিবের মত কাউকে আগে সামলাইনি। না আমাদের খেলাধুলার জগৎ বা আমাদের সাংবাদিক মহল – সবার কাছেই সাকিব নতুন একটা ধারণা নিয়ে এসেছেন। ফলে, সাকিবকে সামলাতে গিয়ে আমরা ঘাবড়াই, মাথা চুলকাই।

মোদ্দা কথা হল, মাঠে হোক আর মাঠের বাইরে হোক সাকিব হলেন সত্যিকারের একজন চৌকশ আর একরোখা মানুষ। তিনি মাঠে প্রতিপক্ষের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠবেন। মাঠের বাইরেও তাই! সাকিব দর্শকদের জুতাপেটা করবেন, ক্যামেরার দিকে অশ্লিল ইঙ্গিত করবেন, কখনও সাংবাদিকদের গালি দিবেন, সাক্ষাৎকারে বিস্ফোরক মন্তব্য করবেন, আজ এই ব্যবসা কাল ওই ব্যবসায় টাকা ঢালবেন।

সাকিব যখন তখন বোর্ডের কাছে ছুটি চাইবেন, অনুশীলন ফাঁকি দিয়ে বিজ্ঞাপনের শ্যুটিংয়ে যাবেন, বায়োবাবলে থেকে কোনো বানিজ্যিক প্রচারণায় সামিল হবেন, আবার সংবাদ সম্মেলনে উইটিনেসের পরিচয় দিয়ে বাকিদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন – হ্যাঁ, এভাবেই গণমাধ্যমটা সামলাতে হয়। মানেন আর নাই মানেন এটাই আমাদের সাকিব। তিনি সত্যিকারের একটা ধাঁধা, একটা রহস্য। এই ধাঁধার কোনো সমাধান নেই। আর এই ধাঁধাটা আছে বলেই তিনি সাকিব, না থাকলে তিনি আর সাকিব হতেন কি করে!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link