‘তুমি আমাকে বিষ দিলেও আমি খাবো’ – অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে এমনটাই বলছিলেন আফগান তারকা রশিদ খানের মা। করোনায় আক্রান্ত হয়ে বিছানায় ছিলেন, সাথে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা। যেসব তিনি খেতে চাইতেন না, সেগুলো খেতেই ছেলের কাছে আবদার জানালেন। লবণ ও কিছু খাবার (শরীরের জন্য অনুপযোগী) খেতে চাইলেন! কিন্তু, মায়ের জন্য জুসের প্রস্তাব রাখলেন রশিদ।
জুস বানানোর পর মায়ের রুম ছেড়ে নিজের ঘরে ফিরে এলেন। যেসব জিনিস তাঁর মা স্পর্শ পর্যন্ত করেন না – সেসব খেতে চাওয়ায় বেশ অবাক হলেন রশিদ। হঠাৎ ছোট বোনের কান্নায় একটা ধাক্কা খেলেন! দ্রুত নিচে ছুঁটে গেলেন। রশিদের দিকে একবার তাকানোর পর পরই মায়ের মাথাটা নিচে ঝুঁকে গেল। তখনো রশিদ বুঝতে পারছিলেন না কি ঘটতে যাচ্ছে। পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে, মা যে চলে যাচ্ছেন পরপারে।
কয়েক মাস ধরে অসুস্থ মায়ের পাশে বসে সেবা করেছেন।পা মালিশ করে দিতেন নিজ হাতে। একদিন রাতে – ভোর তখন চারটে প্রায়। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় মায়ের। উঠে দেখলেন ছেলে পা টিপছেন।
‘তুমি এখনও ঘুমাও নি?’ মায়ের প্রশ্নের প্রতিত্তোরে রশিদ বললেন, ‘না, আমি ঘুমিয়ে পড়বো, তুমি এখন ঘুমাও।’
মায়ের মুখটা শেষ বার দেখেছিলেন – সেই স্মৃতি এখনও সাতরে বেড়ায় চোখে। মায়ের মৃত্যুর দু’দিন পর হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠে পাশে থাকা ছোট ভাইকে ডেকে বললেন, ‘আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছি, মায়ের খেয়াল রেখো।’
এরপর রশিদ বুঝতে পারলেন, এসব কি করছেন তিনি! মায়ের সাথে সম্পর্কটা ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। একবার তো প্রায় ১১ ঘন্টা ধরে ভিডিও কলে মায়ের সাথে কথা বলেছিলেন। মায়ের মৃত্যুর পরেও সেসব স্মৃতি তাড়া করে বেরিয়েছে রশিদকে। রশিদ ঠিক মত ঘুমাতে পারতেন না। কোনো এক ধাক্কায় জেগে উঠতেন, মায়ের স্মৃতি মনে করে। মায়ের সুমধুর কণ্ঠ আর ভালবাসা – সব কিছু তাড়া করে বেড়াত এই আফগান তারকাকে।
মায়ের কণ্ঠস্বর ছাড়াও আরেকটা বেশ পরিচিত শব্দ রশিদের কানে বাজে। হ্যাঁ, বোমার শব্দ! রশিদ তথা আফগানিস্তানবাসীর জন্য এটা বেশ পরিচিত এক শব্দ।
অনূর্ধ্ব-১৯ দলে যখন ছিলেন এক মধ্যরাতে হুট করে বিকট এক শব্দ শুনলেন। ভাবলেন তাঁদের ওই এরিয়াতে আক্রমণ করা হয়েছে। হয়ত একটা দল এক্ষুনি রুমে এসে বলবে ‘ শ্যুট দেম। ‘ রুমের দরজা বন্ধ করে মেঝেতে বসে রইলেন রশিদ। পরক্ষণেই কেউ এসে জানালো তাঁদের ভবনে এই হামলা হয়নি। তবুও সেই রাতে ১ টা থেকে সকাল ৮ টা অবধি সবাই মিলে মেঝেতে বসেই পার করেছিলেন।
আফগানিস্তানে কখনো খারাপ কিছু শুনলেই এই শব্দটা রশিদকে বেশ নাড়া দেয়। ছোটবেলায় রশিদকে বের হতে দিতেন না বাবা-মা। অনেকটা ঘর বন্দি থাকতেন তিনি। এর কারণ ছিল বের হলে যদি ভুল সময়ে ভুল কোনো জায়গায় অস্ত্রবাহীদের হাতে ধরা পড়ে যান। বড় হবার পর পড়াশোনার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানে পাঠানো হয় রশিদকে। এর আগ অবধি বাড়ির মধ্যেই থাকতেন তিনি।
মায়ের মৃত্যুর ১৮ মাস আগে অস্ট্রেলিয়ায় বিগ ব্যাশ খেলছিলেন রশিদ। সেখানেই হঠাৎ খবর পেলেন বাবার অবস্থা ভাল নয়। রশিদ অবশ্য বিশ্বাস করতে পারলেন না। কারণ দিন কয়েক আগেই বাবার সাথে আধ ঘন্টা ধরে তিনি কথা বলেছেন। বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘কি ধরনের জুতা দরকার?’
বিগ ব্যাশে থাকার কারণে লম্বা সময় বাবাকে দেখেননি; বাবা অবশ্য গ্রামে ছিলেন লম্বা সময়। অসুস্থতার খবর পেয়ে ভাইকে বললেন, ভিডিও কল দিতে – বাবাকে দেখবেন। কিন্তু বাবা তখন আইসিউতে শয্যাশায়ী। কথা হল না, দেখাও নেই। এরপর ঘন্টাখানেকের মাঝে খবর পেলেন বাবা আর নেই! মায়ের ভালবাসার ছায়াতলে শোক কাটিয়ে না উঠতেই মায়ের বিদায়!
ক্রিকেট বিশ্বজুড়ে এখন রশিদের বন্ধু অসংখ্য। বিগ ব্যাশ, পিএসএল, আইপিএল, সিপিএল সহ বিশ্বের বিভিন্ন টি-টোয়েন্টি লিগে দাপিয়ে বেড়ানো রশিদ এখন বিশ্বসেরা স্পিনার।
তবে, রশিদের মনে আছে এক অপূর্ণ বাসনা। ঘরের মাটি কাবুলে তিনি খেলতে চান, হাজার হাজার দর্শকের সামনে। আইপিএলের মাঠে যেমন ভারতীয় কোনো ব্যাটার নামলে দর্শকরা হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠে, সেই ব্যাপারটাই অনুভব করতে চান রশিদ।
আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে যেভাবে লাখো মানুষের সামনে আইপিএলের ফাইনাল খেলেছেন – হয়ত কোনো এক দিন কাবুল ভর্তি দর্শকের সামনে এভাবেই মাঠে নামবেন তিনি। উইকেট শিকার করতেই কাবুল স্টেডিয়ামজুড়ে দর্শকদের উল্লাস, হৈ-হুল্লোড় থাকবে। রশিদ রশিদ রব উঠবে একদিন ঘরের মাটিতে – আপাতত স্বপ্নটা এটাই।