সময় যখন প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়; মহাবীরও তখন পরাস্ত হয়, পরাস্ত হতে হয়। গত এক যুগ কিংবা তারও বেশি সময় ধরে যেসব ফুটবলযোদ্ধারা মাতিয়ে রেখেছিল, তারাই আজ বয়সের ভারে ক্লান্ত। মলিন মুখে ফুটবলের সেই যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন অনেকে। হয়তো আর কিছু সময়, এরপরই বিদায় বলে দিবেন তাঁরা।
ক্যারিয়ারের গোধূলি লগ্নে থাকা এসব তারকাদের জন্য খুব সম্ভবত শেষ বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে কাতারের অনুষ্ঠিত ২২তম আসরটি। এরপর হয়তো কখনো বিশ্ব আসরে নিজ দেশের প্রতিনিধি হয়ে মাঠে দেখা যাবে না তাদের। ২০২২ সালের এই ফিফা বিশ্বকাপটি যাদের ক্যারিয়ারের সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে এমন কয়েকজনকে নিয়ে আজকের আয়োজন৷
- ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো (পর্তুগাল)
ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। পেশাদার ফুটবলে পা রাখার পর থেকেই মুগ্ধ করেছেন বিশ্বকে। আর বিশ্বকাপে এই ফরোয়ার্ডের অভিষেক হয়েছিল ২০০৬ সালে। এরপর আরো তিনটি আসরে খেলা হয়েছে তাঁর।
গত ফেব্রুয়ারিতেই বয়স ৩৭ হয়েছে, আগামী আরেকটি বিশ্বকাপ আসতে আসতে চল্লিশের কোটা পেরিয়ে যাবে রোনালদোর। তাই ধরেই নেয়া যায় এবারই হয়তো শেষবারের মত পর্তুগালের আর্মব্যান্ড বাহুতে বেঁধে বিশ্বজয়ের মিশনে যোগ দিবেন তিনি। ক্যারিয়ারে উল্লেখযোগ্য সব শিরোপা জেতা হয়েছে, এখন বাকি সোনালী ট্রফিটি। আগের তুলনায় এখন পর্তুগাল দল অনেক বেশি ভারসাম্যপূর্ন, বিদায়ের আগে তাই বিশ্বজয়ের জন্য রোনালদোর সামনে সুবর্ন সুযোগ রয়েছে৷
- লিওনেল মেসি (আর্জেন্টিনা)
আর্জেন্টাইন অধিনায়ক লিওনেল মেসির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সন্দেহ নেই কারো। ফুটবল ইতিহাসের সেরা ফুটবলারদের তালিকায় উপরের সারিতেই থাকবেন তিনি। তবে এই কিংবদন্তির আক্ষেপের নাম ফিফা বিশ্বকাপ। ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে অল্পের জন্য হাত থেকে ফসকে গিয়েছিল মর্যাদার শিরোপাটি।
২০০৬ সালে অভিষেকের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৪টি বিশ্বকাপ খেলেছেন মেসি, এবার ২০২২ সালে ক্যারিয়ারের পঞ্চম এবং সম্ভবত শেষ বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন পিএসজি তারকা। তার দেশ আর্জেন্টিনাও আছে উড়ন্ত ফর্মে, টানা ৩৩ ম্যাচ পরাজয়ের মুখ দেখেনি তারা। এবার তাই কাতারে দারুন কিছু করার স্বপ্ন দেখতেই পারেন লিও মেসি।
- রবার্ট লেওয়ানডস্কি (পোল্যান্ড)
রবার্ট লেওয়ানডস্কিকে গোলমেশিন বললে ভুল হবে না৷ প্রতি মৌসুমে ভুরি ভুরি গোল করে খবরের শিরোনাম দখলে রাখেন এই পোলিশ তারকা। তবে আন্তজার্তিক পর্যায়ে তুলনামূলক খর্বশক্তির দল পোল্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করায় বলার মত কিছু করার সুযোগ নেই বললেই চলে।
তারপরও প্রায় নিজের চেষ্টায় দলকে নিয়ে পাইয়ে দিয়েছেন কাতার বিশ্বকাপের টিকিট। ৩৩ বছর বয়সী এই ফুটবলারের জন্য হয়তো এটাই শেষ বিশ্বকাপ। আপাতত পোল্যান্ডের হয়ে বিশ্বজয়ের আশা করাটা অমূলক, তারপরও হয়তো নিজের শেষসময়ে এসে স্মরনীয় কিছু করতে চাইবেন লেওয়ানডস্কি।
- লুকা মদ্রিচ (ক্রোয়েশিয়া)
রিয়াল মাদ্রিদ মিডফিল্ডার লুকা মদ্রিচ বর্তমান সময়ে অন্যতম সেরাদের একজন। এছাড়া গত এক যুগে রোনালদো-মেসির বলয় ভেঙ্গে ব্যালন ডি-অর জেতা একমাত্র ফুটবলারও তিনি। ব্যালন ডি’ অর জেতার বছরেই তার দেশ ক্রোয়েশিয়াকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন লুকিতা।
শিরোপা জিততে না পারলেও সেবার রানার আপ হয়েছিল ইউরোপের দেশটি। এবার আরেকবার এমন কিছু করতে কাতারে যাবে ক্রোয়েশিয়া। তাছাড়া ৩৬ বছর বয়সী লুকা মদ্রিচের জন্য এটাই হতে যাচ্ছে শেষ বিশ্ব আসর। তাই শেষবারের মত দেশকে আনন্দের উপলক্ষ এনে দিতে নিজের সবটুকু দিয়েই চেষ্টা করবেন এই বর্ষীয়ান ফুটবলার।
- ম্যানুয়েল নয়্যার (জার্মানি)
‘সুইপার কিপার’ হিসেবে নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন জার্মান গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নয়্যার। ২০১০ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিলেন তিনি। সেবার না পারলেও পরের আসরেই ফুটবলের সবচেয়ে আকাঙ্খিত শিরোপা নিজের করে নিয়েছিলেন।
মুদ্রার অন্য পিঠও দেখেছিলেন এক আসর পরে। ২০১৮ সালে তার ভুলে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়েছিল জার্মানিকে। নয়্যারের বর্তমান বয়স ৩৬ বছর, ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ-ই হয়তো এই কিংবদন্তি গোলরক্ষকের জন্য শেষ বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট। সুখস্মৃতি আর দু:সহ স্মৃতি পিছনে রেখে তাই শেষটা স্মরনীয় করে রাখতে চাইবেন বায়ার্ন সুপারস্টার।
- লুইস সুয়ারেজ (উরুগুয়ে)
বিশ্বের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার উরুগুয়ের লুইস সুয়ারেজ। বিশ্বকাপেও তার বেশ স্মরনীয় কিছু মুহূর্ত আছে। ২০১০ বিশ্বকাপ ঘানার বিপক্ষে হাত দিয়ে গোল ফেরানো কিংবা ২০১৪ সালে ইতালির ডিফেন্ডার কিয়েলিনিকে কামড়ে দেয়া – ভোলার মত ঘটনা নয় মোটেই। আয়াক্স, লিভারপুল, বার্সেলোনার মত বড় বড় ক্লাবে খেলার পর এখন ক্যারিয়ারের শেষবেলায় এসেছেন উরুগুয়ান তারকা।
২০১০ সালের বিশ্বকাপে অভিষেকের মধ্য দিয়ে যেই যাত্রা তিনি শুরু করেছিলেন ২০২২ সালে এসে সেটি শেষ হতে যাচ্ছে। অন্যান্যবারের মত হাত বা দাঁত দিয়ে নয়, এবার হয়তো পায়ের জাদুতেই মনে রাখার মত কোন মুহূর্তের জন্ম দিবেন ‘এল পিস্তেলেরো।
- দানি আলভেস (ব্রাজিল)
আধুনিক সময়ে রাইটব্যাকের সংজ্ঞা বদলে দেয়া এক ফুটবলার দানি আলভেস৷ ব্রাজিলিয়ান এই ফুলব্যাক ইতোমধ্যে নিজের লম্বা এক ক্যারিয়ার শেষ করে এসেছেন। ট্রফি জয়ের হিসেবে ফুটবল ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় তিনি। তবে এখনো ছুঁয়ে দেখা হয়নি বিশ্বকাপ।
৩৮ বছর বয়সী এই ফুটবলার এবার হয়তো শেষবারের মত বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন পূরণের সুযোগ পাচ্ছেন। ফিটনেস ইস্যুতে তিতের স্কোয়াডে জায়গা পাবেন কি না তাতে একটু সংশয় আছে, তবে জায়গা পেলে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে কোন ছাড় দিতে চাইবেন না সাবেক বার্সা তারকা।
- অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া (আর্জেন্টিনা)
আর্জেন্টিনা দলে লিও মেসির পরে যে কয়েকজনের উপর সবচেয়ে বেশি ভরসা করা যায় তাদের একজন আনহেল ডি মারিয়া। সর্বশেষ কোপা আমেরিকাতেও তার গোলেই শিরোপা জিতেছিল লাতিন আমেরিকার জায়ান্টরা। ৩৩ বছর বয়সী এই উইঙ্গারের চোখ এবার কাতারে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্বকাপে। ২০১৪ সালে তিনি ইনজুরির কারণে ফাইনালে খেলতে পারেননি, এবার খুব করেই চাইবেন নিজের অসমাপ্ত কাজটা শেষ করতে।
এরা ছাড়াও থিয়াগো সিলভা, সার্জিও রামোস, পেপে, ম্যাট হামেলস, ডিয়েগো গডিনের মত সেরা ডিফেন্ডারদের জন্য শেষের বার্তা হিসেবেই বাজছে কাতার বিশ্বকাপের সুর। এছাড়া বিশ্বকাপজয়ী থমাস মুলার, অলিভার জিরুদ, হুগো লরিস, সার্জিও বুসকেটসদের ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে এবারের আসরটি।
বিদায় আছে বলেই ফুটবল এতো সুন্দর। ফুটবল খেলার নির্মমতা-ই হয়তো সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। আপনি চাইলেও অনেক কিছু করতে পারবেন না। প্রতি আসরেই অনেক প্রিয় ফুটবলারকে বিদায় বলতে হয়, আবার কখনো কখনো অবশ্য প্রিয়দের তালিকায় যোগ হয় নতুন নাম। প্রকৃতির এমন হেঁয়ালিপূর্ণ আচরন থামানো যায় না। প্রিয় খেলোয়াড়দের অশ্রুসিক্ত বিদায় হয়তো পূর্ণতা দেয় বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাটিকে।