অব্যবস্থাপনাই অপমৃত্যুর কারণ

আমের আচার হবে। তবে গাছ থেকেই আম পেরেই তো আর তা দিয়ে আচার তৈরি করা সম্ভব নয়। আবার মোরব্বা করবার আয়োজন করে তো আর টক আচার তৈরি করাও সম্ভব নয়। প্রতিটা ফাইনাল প্রোডাক্ট পাওয়ার কিছু নির্দিষ্ট পন্থা থাকে, থাকে কিছু নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া।

তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যেন কোন ধরণের প্রক্রিয়ার অনেকটা উর্ধ্বে। যখন যা মনে চায় তখন তাই যেন করে বসে টিম ম্যানেজমেন্ট। সঠিক একটা পন্থা অবলম্বন করবার ইচ্ছে শক্তির বড্ড অভাব কিংবা বিশাল সব দায়িত্ব সামলে পরিকল্পনার ছক কষতে খানিকটা হাপিয়ে ওঠেন কর্তারা। এই যেমন এনামুল হক বিজয়ের জাতীয় দলের প্রত্যাবর্তনের কথাই ধরুণ না কেন।

এনামুল হক নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা একটা সময় কাটিয়েছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। তবে সেটা অবশ্যই সাদা বলে। আরেকটু নির্দিষ্ট করে বললে ওয়ানডে ফরম্যাটে। গোটা দুনিয়ার ‘লিস্ট এ’ ক্রিকেটের এক মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ রানের দেখা পেয়েছেন বিজয়। হাজারের অধিক রান করেছেন ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে।

এরপর স্বাভাবিকভাবেই তাঁর ডাক আসে জাতীয় দল থেকে। যত যাই হোক এমন অনবদ্য পারফরমেন্সের একটা পুরষ্কার তো দেওয়া চাই। সে পুরষ্কার হিসেবেই বিজয়কে প্রথমে অন্তর্ভুক্ত করা হল ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দলে। দীর্ঘ একটা বিরতির পর প্রত্যাবর্তনটা হবে বিদেশের মাটিতে- ওয়েস্ট ইন্ডিজে। তো বেশ ভাল কথা। সাদা বলের ক্রিকেটে ফিরবেন বিজয়। মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে সে মোতাবেক নিজেকে প্রস্তুত করে নেওয়ার কাজটা ঠিক করে যাচ্ছিলেন বিজয়।

হুট করে খবর এলো বিজয়কে নেওয়া হল টেস্ট দলে। তড়িঘড়ি করে বিজয় রওনা দিলেন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের উদ্দেশ্যে। তাঁকে খেলিয়ে দেওয়াও হল দ্বিতীয় টেস্ট ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। কিন্তু এই হুট করে পারফরম করা ফরম্যাটের বদলে ভিন্ন আরেক ফরম্যাটে নামিয়ে দেওয়াটা ঠিক কতটা যুক্তিসংগত? এই উত্তর জানা নেই। মানসিক প্রস্তুতির সময়টুকুও বিজয় পাননি।

আর ক্রিকেটীয় প্রস্তুতির কথা না হয় বাদই দেওয়া যায়। কিন্তু এতে করে হল কি? বিজয় ফেল করলেন টেস্ট ক্রিকেটে। তাঁর আত্মবিশ্বাস খানিকটা মুষড়ে গেল। তাছাড়া বিজয়ের ফুটওয়ার্কেও যে একটা সমস্যা ছিল, সেটা যে ঠিক হয়নি তাও যেন আবার স্পষ্ট হল। সে যাই হোক কোন রকম বিজয় নিশ্চয়ই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। জাতীয় দল থেকে ডাক এসেছে, দাঁতে দাঁত কামড়ে পড়ে না থাকলে কি চলে!

বিজয়কে আবার সুযোগ দেওয়া হল টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে। সেখানেও বিজয়ের ব্যাট হাসেনি। আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি নিশ্চয়ই ছিল। তাছাড়া দলের ব্যাটারদের যাচ্ছেতাই পারফরমেন্স বাড়তি একটা চাপ সৃষ্টি করছিল তা নিয়ে সন্দেহর অবকাশ তো আর নেই। ব্যাস! তাতেই বিজয় পরিকল্পনার বাইরে যাওয়ার রাস্তায় হাটা ধরলেন।

তবে সবচেয়ে অদ্ভুত করা কাণ্ড, বিজয় খেললেন না ওয়ানডে ফরম্যাটে। অথচ এই ফরম্যাটটাতেই তিনি দারুণ একটা সময় কাটিয়েছেন। সে সময়ের পুরষ্কার হিসেবেই তিনি জাতীয় দলে। তবে না টিম ম্যানেজমেন্ট সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁকে খেলানো হবে না। এর পেছনে অবশ্য অধিনায়ক তামিম ইকবালের ভিন্ন মতাদর্শ রয়েছে। প্রথম ওয়ানডে জয়ের পর তামিম সেটা অকপটে গণমাধ্যমেও বলেছেন।

তিনি বলেন, ”অধিনায়ক হিসেবে আমি এটা করতে চাই। দল নির্বাচন এভাবে করতে চাই। একটা ছেলেকে (নাজমুল হোসেন শান্ত) দলে রাখছি, মাঝখান থেকে আরেকজন এলো, তাকে চট করে খেলিয়ে দিলাম, আমি এভাবে ভাবি না। তাই আমার মনে হয়, আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

অধিনায়কের ইচ্ছেতেই বিজয়ের খেলা হয়নি ওয়ানডে ম্যাচ। তা অধিনায়ক নিজের জায়গায় শতভাগ সঠিক। তবে প্রশ্নটা আসলে করতে হবে বাকি দুই ফরম্যাটে বিজয়কে খেলিয়ে তাঁর আত্মবিশ্বাস চূর্ণ করা নিয়ে। ঠিক কোন কারণে বিজয়কে খেলাতেই হল টেস্ট ক্রিকেট? খেলোয়াড়দের ইনজুরি। তবে কেন বাংলাদেশ দলের নির্বাচকরা এই ইনজুরির মত অবিশ্যম্ভাবী এক বিষয়কে মাথায় রেখে খেলোয়াড় নির্বাচন করবেন না?

বাংলাদেশ ক্রিকেটে এই প্রশ্নের উত্তর যেন কারও কাছে নেই। আবার ঠিক তামিম ইকবালের মত করেই কেনই বা বাকি অধিনায়করা এনামুলকে জাতীয় দলের আশেপাশে একটু সময় কাটাতে দিতে পারলেন না? চট জলদি তাঁকে মাঠে নামিয়ে দেওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন ছিল না নিশ্চয়ই। তাঁকে একটু দলের বর্তমান আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নেওয়ার সময় করে দেওয়াই যেত। কিন্তু সেটা করা হয়নি।

একজন খেলোয়াড় যখন ইচ্ছে হয় দলে নিলাম, যখন ইচ্ছে হয়ে দল থেকে ছাটাই করলাম তা তো আর চলতে পারে না। একটা জাতীয় দলে এমন অব্যবস্থাপনা নিশ্চয়ই মেনে নেওয়ার মত নয়। একটা নির্দিষ্ট নিয়ম তো অনুসরণ করা উচিৎ। নতুবা গোজামিল দিয়ে অন্তত ক্রিকেটে উন্নতি করা অসম্ভব। একটা নির্দিষ্ট এবং স্বচ্ছ পথ অবলম্বন করাটা যেন রীতিমত এখন সময়ের দাবি।

তা না হলে অন্তত এই বিজয়রা নিজেদের ফর্মের সঠিক ব্যবহারটা করতে পারবেন না আন্তর্জাতিক মঞ্চে। দারুণ সব সম্ভাবনার অপমৃত্যুর জন্য এমন সব অব্যবস্থাপনাই তো দায়ী। এসব কিছুই আমাদের খেলোয়াড়দের নিজেরদের সর্বোচ্চটুকু উজাড় করা থেকে পিছিয়ে দেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link