বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। বাবাকে হারালেন। মা চাইলেন, বাবা হারানো শিশুটির স্বপ্নটা পূরণ করতে। ছাড় দিলেন ক্রিকেট খেলার জন্য। আর এটাই যেন গতিবিধিটা পাল্টে দিল রমেশ শান্থা কালুভিতারানার জীবনের।
কলম্বোতে ১৯৬৯ সালের ২৪ নভেম্বর তাঁর জন্ম। মোরাতুয়ার সেইন্ট সেবাস্টিয়ান কলেজের ছাত্র তিনি। সেখান থেকেই বের হয়েছেন লঙ্কান গ্রেট দিলীপ মেন্ডিস। যদিও, কালুভিতারানা মেন্ডিস নন, বেশি অনুসরণ করতেন ‘ভয়ডরহীন ব্যাটিংয়ের শেষ কথা’ খ্যাত স্বয়ং ভিভ রিচার্ডসকে। বলটার জন্ম হয়েছে স্রেফ মার খাওয়ার জন্য – এই ধারণায় বিশ্বাস করতেন কালুভিতারানাও।
নব্বইয়ে দশকের ক্রিকেট ফলোয়াররা এই নামটার সাথে পরিচিত। যদিও, লঙ্কান এই ক্ষুদে সাবেক উইকেটভক্তকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রায়ই ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের কথা বলা হয়। তাঁর আর সনাৎ জয়াসুরিয়ার ওপেনিং জুটির কথা বলা হয়।
যদিও, সেই বিশ্বকাপে তিনি ছয় ম্যাচে করেছিলেন মোটে ৭৩ রান। কালুভিতারানা মূলত বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়া সফরে নিজের সক্ষমতার পরিচয় দেন। সেখানে ত্রিদেশীয় সিরিজে তিনি তিনটি হাফ সেঞ্চুরি করেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে উদ্বোধনী জুটির ধারণা পাল্টে যেতে শুরু করে।
আধুনিক ওয়ানডে ক্রিকেটে তিনি বেশি গুরুত্ব পেলেও, টেস্টেও তিনি কম পারদর্শী ছিলেন না। তিনি টেস্ট অভিষেকেই সেঞ্চুরি করা মাত্র তিনজন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের একজন। ১৯৯২ সালের আগস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজের প্রথম টেস্ট ইনিংসেই ১৩২ রান করেন কালুভিতারানা।
সেখানেই অবশ্য ‘মারমার কাটকাট’ ব্যাটিংয়ের বীজটা বোনা হয়ে গিয়েছিল। ইনিংসটা ছিল ১৫৮ বলের। এর মধ্যে চারই ছিল ২৬ টা। মানে স্রেফ বাউন্ডারি থেকেই করেন ১০৪ রান!
তাঁর সাথে জয়াসুরিয়ার জুটি বেশ জমে গিয়েছিল। তবে, জয়াসুরিয়া বরাবরই ছিল অগ্রগামী ব্যাটসম্যান। ১৯৯৬ সালে সিঙ্গাপুরের পাদাঙে অনুষ্ঠিত সিঙ্গার কাপের ফাইনালে জয়াসুরিয়া ১৭ বলে হাফ সেঞ্চুরি (তখনকার দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরি)। উদ্বোধনী জুটি ভাঙে ৭০ রানের মাথায়। তখন ৬৬ রানে অপরাজিত মাতারা হারিকেন। বাকি চার রান আসে অতিরিক্ত খাত থাকে। মানে, কোনো রান না করেই সাজঘরে ফেরেন কালুভিতারানা।
তবে, পিঞ্চ হিটিং ওপেনিং জুটি হিসেবে এই দু’জন ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য। দু’জনই ছিলেন মেকশিফট ওপেনার। তারা ওয়ানডে ব্যাটিংয়ে শুরুর ধারাটাই বদলে দিয়েছিলেন আজীবনের জন্য। রান তোলার গতিতে তাঁরা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন।
এমন দারুণ শুরুর পরও সেদিন ২১৬ রান তাড়া করতে ব্যর্থ হয় শ্রীলঙ্কা। অল আউট হয় ১৭২ রানে।
উইকেটরক্ষক হিসেবে তুখোড় ছিলেন কালুভিতারানা। বিশেষ করে, উইকেটের পেছন থেকে স্পিন কিংবদন্তি মুত্তিয়া মুরালিধরণের ট্রিক্সগুলো ধরতে পেরে সে অনুযায়ী ভূমিকা রাখতে পারতেন তিনি।
প্রতিযোগীতামূলক ক্রিকেটে চারটি উইকেট পাওয়ার কীর্তিও আছে কালুভিতারানার। এর মধ্যে ২০০২-০৩ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া সফরে ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে ১.৫ ওভার বোলিং করে তিন উইকেট নেন কালুভিতারানা। রান দেন মাত্র দু’টি!
কুমার সাঙ্গাকারার আবির্ভাবের পর লঙ্কান দলে রমেশ কালুভিতারানার প্রয়োজন কমে আসতে থাকে। তারপরও কালুভিতারানা ফিরে এসেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে, দুই ফরম্যাটেই। টেস্টে ব্যাটিংয়ে মনোযোগী হতে চাওয়া সাঙ্গাকারা একাদশে কালুভিতারানার ফেরাটা সহজ করে দেয়।
২০০৪ সালে শেষ টেস্ট খেলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে করাচিতে। শেষ ইনিংসেও করেন হাফ সেঞ্চুরি। তবে, এরপরও পরের সিরিজের প্রাথমিক স্কোয়াডে ঠাই হয়নি। রমেশ তাই দল ঘোষণার পরদিনই অবসরের ঘোষণা দিয়ে দেন আনুষ্ঠানিক ভাবে।
ক্যারিয়ার শেষ করে কোচিং করেছেন, আইসিসির ক্রিকেট ডেভেলপমেন্টের অধীনে ক্রিকেটের প্রচারও করেছেন। তবে, বর্তমানে কালুভিতারানার সবচেয়ে বড় পরিচয় হল তিনি পুরোদস্তর হোটেল ব্যবসায়ী। শ্রীলঙ্কার উদা ওয়ালাওয়া জাতীয় উদ্যানের পাশেই তাঁর হোটেল – ‘কালুস হাইডঅ্যাওয়ে’। কালুও যেন ঠিক সেভাবেই লুকিয়ে আছেন নব্বইয়ের হাজারো কিংবদন্তির ভিড়ে!
কালুভিতারানার ব্যাটিং মোটেও মনোহর ছিল না। খুব প্রতিভাবান, বিরাট কোনো ম্যাচ উইনার বা কালজয়ী কেউ ছিলেন না। তবে, দর্শকদের বিনোদনের খোড়াক যোগানোর কাজটা শতভাগ নিষ্ঠার সাথে করতে জানতেন তিনি। তিনি ছিলেন নির্ভার ও নির্ভীক – তবে প্রতিপক্ষের জন্য কখনো কখনো হয়ে উঠতে পারতে ভীতিকর। তাতে দর্শকের অ্যাড্রেনালিন রাশ হত, বিনোদনপ্রেমী দর্শকদের কাছে তাই তিনি আজো স্মরণীয়।