তরী ভেড়ানোর দক্ষ নাবিক

‘কোটার খেলোয়াড়’ এই তকমাই যেন জুড়ে গেছে নুরুল হাসান সোহানের নামের পাশে। উইকেটের পেছনে দস্তানা হাতে বাংলাদেশে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তিনি এক কথায় দূর্দান্ত। চৌকস এক বাজপাখি। তাই বলেই হয়ত তিনি জায়গা পেয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলে। এই চিন্তা মাথায় নিয়ে বসবাস বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্রিকেট ভক্তদের।

তবে সোহান যেন এই মতের দেয়ালে কষিয়ে হাতুড়ি পেটা করছেন। না তিনি একেবারে শতক হাঁকিয়ে, প্রতিপক্ষ বোলারদের তুলোধুনো করে এক হাত দেখে নিচ্ছেন বিষয়টা তেমন নয়। তবে তিনি যে কাজটা করছেন সেটা প্রমাণ করে সোহান কেবলমাত্র একজন উইকেটরক্ষক হিসেবেই একাদশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নেই।

প্রশ্ন জাগতে পারে, কি এমন করেছেন নুরুল হাসান সোহান? ২০১৬ সালে ওয়ানডে অভিষেক হওয়া সোহানের ব্যাটিং গড় এখন ৮২.৫০। অবিশ্বাস্য! বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অবশ্যই। কিন্তু মাত্র ছয়টি ম্যাচ খেলার পর এমন গড় নিয়ে আনন্দ-উল্লাস করবার মত কিছু নেই। তবে একেবারে হেলায় হারিয়ে ফেলার মতও কিছু নেই। কেননা এই ছয় ইনিংসের সবক’টি বিদেশের মাটিতে।

তাঁর থেকেও মজার বিষয়, তিনি প্রায় প্রতিটা ম্যাচেই সাত নম্বরে ব্যাট করতে নেমেছেন। ব্যাটিং অর্ডারের লেজটা বাইশ গজে চলে আসার ঠিক আগ মুহূর্তে মাঠে নেমেছেন। খেলেছেন নিউজিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মত দলের বিপরীতে।তাঁর থেকেও বড় কথা তিনি খেলেছেন দলের একেবারে কঠিন মুহূর্তে। বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং কলাপ্স করবার নজির তো আর কম নেই।

অন্তত নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সোহানের ক্যারিয়ারের প্রথম দুই ম্যাচেই আন্দাজ করে নেওয়ার দরকার ছিল তাঁর ক্যালিবার। ব্যাটিং ধ্বস, এরপর ব্যাটিং অর্ডারের তলানিতে নেমে যথাক্রমে ৩১ বলে ২৪ ও ৩৯ বলে ৪৪ রানের দুইটি মহাগুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন। দ্বিতীয়টি ছিল বাংলাদেশের পক্ষে সে ম্যাচের তৃতীয় সেরা। এরপরের ইনিংসটা তো নিশ্চয়ই সোহান মনে রাখতেই চাইবেন।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রায় তিনশ রানের টার্গেটে ব্যাট করছিল বাংলাদেশ। সেদিনের ম্যাচটায় জয় এনে দিয়েছিলেন সোহান। বুদ্ধিদীপ্ত আর ধৈর্য্যশীল এক ইনিংস খেলে। এমনকি শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন অপরাজিত। ৪৫ রান করেছিলেন তিনি ৩৯ বলে। বাংলাদেশকে জিতিয়েছিলেন ১২ বল বাকি থাকতেই। এমন এক ইনিংসই তো প্রমাণ করে সোহান সুযোগ্য একজন ব্যাটার।

তবে না, তিনি যে ভাল মানের একজন ব্যাটার সেটা মেনে নিতে পারেননি অনেক সমালোচকরা। কেননা সোহান খুব বেশি দৃষ্টিনন্দন একজন ব্যাটার নন। ক্রিকেটের ব্যাকরণ মেনে কোন শটই তিনি খেলতে পারেন না। তিনি বরং নিজে যা পারেন তাই করবার চেষ্টা করেন। সবচেয়ে বড় বিষয় তিনি বাইশ গজের সেই শক্ত মাটিতে মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করেন। তবুও মন তো আর ভরে না। তাই ‘কোটার খেলোয়াড়’ তকমা এঁটে দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন নিন্দুকেরা।

আবারও নিজের ব্যাটিং সামর্থ্যের প্রমাণ রাখলেন সোহান। নিন্দুকের মুখে ঝামা ঘসে দেওয়া না হোক অন্তত নিন্দুকের মুখটা খানিকক্ষণের জন্যে বন্ধ করে দেওয়া গেল। নুরুল হাসান সোহান পুরো ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ জুড়েই সুযোগ পেয়েছেন বাংলাদেশের একাদশে। আর সুযোগটা তিনি কাজে লাগানোর সম্পূর্ণ চেষ্টাই করেছেন। উইকেটের পেছনে ছোটখাটো ভুল করেছেন। আবার দুরন্ত সব স্ট্যাম্পিং করে সেসব পুষিয়ে দিয়েছেন।

তবে কাজের কাজটা তিনি করেছেন ব্যাট হাতে। স্বল্প রানের ম্যাচে তিনি যখনই সুযোগ পেয়েছেন ব্যাট করেছেন পরিস্থিতি বুঝে। তাঁর চাইতেও বিশেষ বিষয় তিনি ইনিংস শেষ করেই মাঠ ছেড়েছেন। শেষ ম্যাচে তো আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশের মিডল অর্ডার তেমন কোন প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। শীতল স্নায়ুর সোহান ঘাবড়ে না গিয়ে রান তুলেছেন। দলের তরী জয়ের বন্দরে ভিড়িয়েছেন।

ওয়ানডের এই ইনিংসগুলোই প্রমাণ করে ব্যাটার সোহানও সমান কার্য্যকর। অপেক্ষা শুরু একটু আস্থার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার। সুযোগ পেলে তিনিও হতে পারেন টাইগারদের যোগ্য ফিনিশার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link