ওয়ানডে সাফল্যের সাত কারণ

টেস্ট আর টি-টোয়েন্টিতে যেমনই পারফরম্যান্স হোক, ওয়ানডেতে বাংলাদেশ যে এখন আর গড়পরতা দল নয় সেটি পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। দেশে কিংবা ভিনদেশি পরিবেশে এখন জিততে পারে তারা। এখন আশা, বিশ্বমঞ্চেও সফলতার মুখ দেখতে পারবে বাংলাদেশ – আপাতত তামিম ইকবালের নেতৃত্বে সেই লক্ষ্যেই এগুচ্ছে বাংলাদেশ।

কিন্তু কি এমন হয় যে টেস্ট আর টি-টোয়েন্টিতে ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে ওয়ানডেতে জ্বলে ওঠে বাংলাদেশ। প্রায় একই খেলোয়াড়, একই স্কোয়াড তবু কেন এত পার্থক্য পারফরম্যান্সে; এমনকি পার্থক্য আছে মানসিকতায়। এর রহস্যটা কি? চলুন জেনে নেই।

  • মোক্ষম মিডল অর্ডার

বাংলাদেশের মিডল অর্ডার মূলত পুরো ওয়ানডে দলের প্রধান শক্তি। বাংলাদেশ দলের অধিকাংশ পঞ্চাশ কিংবা শতরানের জুটিগুলো এসেছে এই মিডল অর্ডার ব্যাটারদের থেকেই। সাকিব আল হাসান এবং মুশফিকুর রহিমের জুটি থেকে এখন পর্যন্ত ৩২২৮ রান এসেছে যা বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ।

২০১৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশের যে উত্থান ঘটেছে তার পিছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছে সাকিব, মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহর দুর্দান্ত ফর্ম। নির্ভরযোগ্য টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের ঘাটতি থাকায় রান সংগ্রহের জন্য এদের উপরেই ভরসাটা সবচেয়ে বেশি। যদিও, মাহমুদউল্লাহ নিজের ফর্মটা অনেকদিন হল পেছনে ফেলে এসেছেন।

অবশ্য এখন পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। লিটন দাস স্বরূপে ফিরেছেন, এছাড়া সাকিব এখন নিয়মিত তিন নম্বরে ব্যাট করেন; তাছাড়া মাহমুদউল্লাহ এখন আছেন অফ ফর্মে। তবে মিডল অর্ডার আগের মতোই, ইয়াসির আফিফদের মত তরুণরা বাংলাদেশের শক্তির জায়গা ঠিক রেখেছে।

  • কৃপণ স্পিনার

গত একযুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশি স্পিনাররা দলের বোলিং আক্রমণের নেতৃত্বে আছেন। তারাই প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানকে চাপে রাখার মূল দায়িত্ব পালন করেন। আর সেই দায়িত্ব ভাল ভাবেই পালন করে আসছেন সাকিব, মিরাজরা।

শুরুর পাওয়ার প্লে থেকে ডেথ ওভার পর্যন্ত সময়টাতে বাংলাদেশকে দাপটের সাথেই ম্যাচে রাখেন তারা। ইনিংসের এই মাঝামাঝি পরিস্থিতিতে স্পিনারদের সবারই বোলিং ইকোনমি গড়ে ৪.৫ এর আশেপাশে। তাছাড়া নিয়মিত উইকেট তুলে নেয়ার সামর্থ্যও দেখিয়েছে বাংলাদেশের স্পিন বিভাগ।

  • বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার

বাংলাদেশে একটি কার্যকরি ওয়ানডে সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছেন সাকিব আল হাসান। পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান আবার মূল স্ট্রাইক বোলার; সাকিবের এই দিত্ব পরিচয় বাংলাদেশকে দিয়েছে বাড়তি সুবিধা।

বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো মাঠে তার উপস্থিতি বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। ধারাবাহিক সাকিব গত একযুগের বেশি সময় ধরেই আছেন সেরা অলরাউন্ডারের র‍্যাংকিংয়ের উপরের দিকে।

  • স্থায়ী ওপেনার

স্থায়ী একজন ওপেনার বাংলাদেশের টপ অর্ডার সুসংহত করেছে। অভিষেকের পর থেকে তামিম ইকবাল আক্রমণাত্বক থাকলেও ২০১৫ সালের পর থেকে দায়িত্ব নিয়ে খেলা শুরু করেন। ঘরের মাঠে কিংবা বিদেশে তার উপস্থিতি মানে বাড়তি নির্ভরতা। এই ফরম্যাটে দেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, সর্বোচ্চ হাফ সেঞ্চুরিয়ান এবং সেঞ্চুরিয়ানও তিনি।

  • উদীয়মান তারুণ্য

বাংলাদেশের ওয়ানডে দলের সবচেয়ে সন্তোষজনক দিক হচ্ছে তরুণ ক্রিকেটাররা। একটা সময় সাব্বির রহমান, সৌম্য সরকাররা অভিজ্ঞদের সাথে তাল মিলিয়ে পারফর্ম করতেন। তারা পথ হারালেও এখন আফিফ, শরীফুলরা জ্বলে উঠছেন নিয়মিত।

এছাড়া মিরাজ, লিটন, ইয়াসিররা তো আছেনই। বাকি দুই ফরম্যাটের চেয়ে ওয়ানডেতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে পারফর্ম করতে পারেন তারা। আর তাই এই ফরম্যাটে শুধু বর্তমানে নয়, ভবিষ্যতেও আধিপত্য ধরে রাখবে সেটা আশা করাই যায়।

  • সাহসী অধিনায়কত্ব

বাংলাদেশ যে জিততে পারে, দলের মধ্যে সেই মনোভাব প্রথমে এনে দিয়েছিল মাশরাফি বিন মর্তুজার অধিনায়কত্ব। ২০১৪ সালে ডুবতে থাকা বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব হাতে পেয়েই বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন তিনি।

তার অধিনায়কত্বেই বাংলাদেশ আইসিসির বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল খেলতে এবং প্রথম ত্রি-দেশীয় শিরোপা জিততে সক্ষম হয়। রেকর্ড পঞ্চাশতম জয় পাওয়ার অধিনায়ক মাশরাফি সরে দাঁড়ান। বর্তমানে তামিম ইকবাল সাহসী কাপ্তানির ধারা অব্যাহত রেখেছেন।

ওয়ানডেতে ফরম্যাটে বাংলাদেশের হয়তো উড়ন্ত সূচনা এনে দেয়ার মত আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান নেই, শেষদিকে অবিশ্বাস্য গতিতে রান তোলার মত পাওয়ার হিটারও নেই।

কিন্তু ব্যাটিং বোলিং উভয় বিভাগেই ইনিংসের মাঝামাঝিতে (১১-৪০ ওভার) যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাংলাদেশ, এটাই তাদের মূল শক্তি। ধীরে ধীরে লাল-সবুজের ক্রিকেট দল যেভাবে ওয়ানডেতে পরাশক্তি হয়ে উঠেছে সেটি নিশ্চিতভাবেই প্রশংসনীয়।

  • ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামো

আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামো নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই। বিশেষ করে প্রথম শ্রেণির কাঠামো। তবে, বাংলাদেশের ওয়ানডে কাঠামোটাই এমন যেখান থেকে ওয়ানডেমনস্ক খেলোয়াড় বের হয়ে আসতে পারে।

এখানে সবচেয়ে জমজমাট ঘরোয়া আসর হল ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ, যার ফরম্যাট মূলত ওয়ানডে। আর এর শুরু সেই স্বাধীনতার পরপরই। ফলে, এই ফরম্যাটে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আছে ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের। যার প্রভাব পড়ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link