নায়কোচিত এক যুগের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় বাইশ গজের পারফরম্যান্সে স্তব্ধ করে দেয়া বেঞ্জামিন অ্যান্ড্রু স্টোকস, এবার মাঠের বাইরে থেকেই অবাক করলেন সবাইকে। জানিয়ে দিলেন আর সম্ভব নয় ক্রিকেটের সব সংস্করণে অংশগ্রহণ করা, ওয়ানডে থেকেই ছুটি নিয়ে নিলেন পুরোপুরি। বেন স্টোকসের এই অবসরের সিদ্ধান্ত ক্রিকেটের ব্যস্ত সময়সূচিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।
ইংল্যান্ডের বর্তমান টেস্ট অধিনায়ক এই ফিক্সচার প্রোগ্রামকে ‘অস্থির’ বলে অভিহিত করেছেন। এই ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ক্রিকেটাররা কোন গাড়ি নয় যে, পেট্রোল দিলে তারা চলতে শুরু করবে।’ সত্যি বলতে ক্রিকেট ম্যাচগুলো এখন অনেক বেশি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বৈশ্বিক ইভেন্ট, দ্বিপাদ সিরিজের পাশাপাশি ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের চাপে বিশ্রামের সময় পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিজি শিডিউলের এই ব্যাপারটি ক্রিকেটের আতুড়ঘর ইংল্যান্ডেই সবচেয়ে বেশি। ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক জো রুট আর কিউই ক্যাপ্টেন কেন উইলিয়ামসনের মাঝে তুলনা করলেই ব্যাপারটি বোঝা যায়।
উইলিয়ামসনের চেয়ে দুই বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেছিলেন রুট। কিন্তু ইতোমধ্যে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটারের চেয়ে বেশি টেস্ট এবং ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ফেলেছেন ইংলিশ তারকা। উইলিয়ামসন ওয়ানডে এবং টেস্ট খেলেছেন যথাক্রমে ১৫১ এবং ৮৮ টি অথচ রুট খেলেছেন ১৫৬ টি ওয়ানডে এবং ১২১ টি টেস্ট।
সবমিলিয়ে ২০১৭ সালের শুরু থেকে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা দেশটির নাম ইংল্যান্ড। গত পাঁচ বছরে তারা ৪৯৮ দিন ক্রিকেটের জন্য নির্ধারণ করেছিলো, যেখানে দ্বিতীয় স্থানে ভারতের ক্ষেত্রে সেটি ৪৭২ দিন। এছাড়া প্রতিদ্বন্দী অস্ট্রেলিয়া তো এই সময়ে মাত্র ৩৮৭ দিন ক্রিকেট খেলেছে। এই পার্থক্য রীতিমতো অবিশ্বাস্য।
চলতি বছরে আন্তর্জাতিক ম্যাচের পরিমাণ আরো বেড়েছে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের জন্য। করোনা মহামারির জন্য গত দুই বছরে স্থগিত হয়ে যাওয়া ম্যাচগুলো ২০২২ সালে খেলতে হচ্ছে তাদের।
এই যেমন সর্বশেষ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে যে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলেছে সেটি মূলত ২০২০ সালে হওয়ার কথা ছিল। এছাড়া নেদারল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে সিরিজের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। এমনকি ভারতের বিপক্ষে শেষ টেস্টটিও গত বছর করোনা আতঙ্কে স্থগিত হয়ে গিয়েছিল এবং কিছুদিন আগে ম্যাচটি পুনরায় খেলতে হয়েছে।
পুরো বছরের কথা বাদ-ই থাকুক, শুধুমাত্র এই মাসেই ইংল্যান্ড দল ১৭ দিন ক্রিকেটের মাঝে রয়েছে। কোন রকমের প্রশিক্ষণ বা বিশ্রাম ছাড়াই ম্যাচ খেলতে হচ্ছে তাদের। দলটির সাদা বলের অধিনায়ক জস বাটলার এই মাসে মাত্র ২৫দিনের ব্যবধানে ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ১২ বার মাঠে নামতে যাচ্ছে।
ইংলিশদের সাদা বলের কোচ ম্যাথু মট তাই অধিনায়কত্বের সাথে জস বাটলারের পরিচয়কে অগ্নিপরীক্ষা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। সবমিলিয়ে ২ জুন থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত ইংল্যান্ড দলের সূচিতে চারটি টেস্ট, নয়টি ওয়ানডে এবং ছয়টি টি-টোয়েন্টি রয়েছে; যেকোনো বিচারে এই সূচি উদ্বেগজনক।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের প্রসার এবং এই ফরম্যাটের উত্থান সাম্প্রতিক সময়ে দ্বিপাক্ষিক সিরিজকে দীর্ঘায়িত করেছে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী টুর্নামেন্ট এবং ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের বিস্তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সূচিকে আরো সংকুচিত করে ফেলছে ৷
ক্রিকেটারদের বিশ্রামের ব্যাপারটি হয়তো নীতিনির্ধারকদের ভাবনায় আছে। কিন্তু সম্প্রচারকদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থের প্রস্তাব দ্বারা প্রভাবিত হতে হয় তাদের। যার ফলে সম্প্রচারকদের দাবি মেটাতে কম ম্যাচের চেয়ে বেশি ম্যাচের ফিক্সচার তৈরি করতে হয়।
ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল তার পরবর্তী ভবিষ্যত সফর কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এবং এই পোগ্রামেও ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারদের জন্য আরেকটি বিরতিহীন ক্রিকেট ম্যাচ রাখা হয়েছে। ইংল্যান্ডকে আসন্ন সময়ে দুইবার পাকিস্তান সফরের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও বাংলাদেশ সফর করতে হবে।
এই ব্যস্ত প্রক্রিয়ায় একটি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে বেন স্টোকসের অকাল অবসরের সিদ্ধান্ত। এমন আরো বৈশ্বিক তারকারা যদি তাদের ক্যারিয়ার বাড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট ফরম্যাট থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করে, তবে কি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল, সদস্য বোর্ড এবং সম্প্রচারকদের তাদের ক্যালেন্ডার পুনর্বিবেচনা করতে রাজি হবেন।
রাজি অবশ্যই হওয়া উচিত; দীর্ঘমেয়াদে ক্রিকেট এবং ক্রিকেটাদের কথা চিন্তা করে হলেও সূচিতে বিশ্রামের জন্য সময় নির্ধারণ করা এখন একান্ত প্রয়োজন।