মার্সেলো বিয়েলসা, একজন বিপ্লবী

মার্সেলো বিয়েলসা নামটা শুনলে নিশ্চয়ই ভেসে ওঠে ২০০২ বিশ্বকাপের কথা। সে সময় তিনি ছিলেন আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের প্রধান কোচ। স্বদেশী কোচ। দলটাকে গড়েছিলেন এক অপ্রতিরোধ্য উদ্দ্যমে। ফেভারিট তকমা গায়ে জড়িয়ে তাঁর দল গিয়ে হাজির হয়েছিল বিশ্বকাপের মঞ্চে।

তবে বিধিবাম। সুবিশাল আকাশসম প্রত্যাশা ধুলোয়া মিলিয়ে যায়। তারকায় ঠাসা আর্জেন্টিনা দলটা বাদ পড়ে যায় গ্রুপ পর্ব থেকে। কথিত আছে সেবার ঝর্ণার বয়ে গিয়েছিল বিয়েলসার দু’টি নয়নজুড়ে। তিনি কেঁদে ভাসিয়েছিলেন সাজঘর। সে এক বিশ্বকাপ আসর প্রায় তিন মাসের ফুটবল আর বিয়েলসার মাঝে দূরত্ব গড়ে দিয়েছিল।

১৯৫৫ সালের ২১ জুলাই আর্জেন্টিনার রোমারিওতে জন্মানো মার্সেলো বিয়েলসা কোচদের আইডল, ‘দ্য মাস্টার মাইন্ড অব ফুটবল’! রক্ষণভাগের একজন ফুটবলার হিসেবেই তিনি শুরু করেছিলেন ফুটবলের সাথে এক মধুর যাত্রা। তবে একজন ফুটবলার হিসেবে তিনি যতটা না সমৃদ্ধ তার থেকেও বেশি বিকশিত হয়েছেন একজন কোচ হিসেবে।

নিউওয়েল’স ওল্ড বয়েজ ক্লাব থেকেই বিয়েলসার ফুটবলের বিশালতায় বিলিন হওয়া। সে ক্লাবের হয়েই প্রথমবারের মত তিনি নেমেছিলেন ডাগআউটে। ১৯৯০ সালের কোচের দায়িত্ব নেওয়ার আগ অবধি ১৯৮০ সাল পর্যন্ত চালিয়ে গেছেন ফুটবলার ক্যারিয়ার। এক সুদক্ষ রক্ষণ ভাগের খেলোয়াড় হিসেবে আর্জেন্টিনার ঘরোয়া লিগের বিভিন্ন ক্লাবে খেলেছেন বিয়েলসা।

সময়ের পরিক্রমায় ফুটবলটা আর ছেড়ে যেতে পারেননি। তবে ফুটবলে নতুনত্ব ঠিকই যুক্ত করেছেন মার্সেলো বিয়েলসা। একেবারে ভিন্নধর্মী এক দর্শন নিয়ে তিনি যেন কাজ করেন। তাঁর দর্শনে যেমন প্রতিপক্ষের একেবারে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ থাকে, ঠিক তেমনি থাকে নিজের কাজটা সুচারুরুপে করে যাওয়া। তিনি যেন তেমনটাই পছন্দ করেন।

তাঁর অধীনে থাকা প্রতিটি খেলোয়াড়ের যেন থাকা চাই পূর্ণ ফিটনেস। কেবল তবেই যেন তিনি এনে দেবেন সাফল্য। এই যে যেমন সাম্প্রতিক সময়ে লিডস ইউনাইটেডের কথাই বলা যেতে পারে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের একসময়ের বেশ দাপুটে ক্লাব লিডস ১৬ বছর ধরে ছিল প্রিমিয়ার লিগ থেকে দূরে।

২০১০ সালের পর থেকে ক্লাবটি এগারো জন কোচ বদল করেছে। তবুও যেন কাজের কাজটি হয়নি। ২০১৮ সালে মার্সেলো বিয়েলসা কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই যেন দৃশ্যপট বদলে যায়। ইল্যান্ড রোডের ক্লাবটি আবারও স্বমহিমায় যেন উজ্জীবিত হতে শুরু করে। স্থান পেয়ে যায় প্রিমিয়ার লিগে। হুট করেই একটি দলকে একেবারে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার কাণ্ড যে একবারই করেছেন বিয়েলসা তা কিন্তু নয়।

২০১১ সালে স্প্যানিশ ক্লাব অ্যাতলেটিকো বিলবাওয়ের দায়িত্ব পান মার্সেলো বিয়েলসা। সে মৌসুমেই ক্লাবটিকে একেবারে নতুন করে যেন পরিচয় করিয়ে দেন গোটা ইউরোপে। প্যারিস সেইন্ট জার্মেই, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, স্পোর্টিং লিসবনের মত ক্লাবদের হারিয়ে দলকে নিয়ে যান ইউরোপা লিগের ফাইনালে। নিজের প্রথম মৌসুমেই একেবারে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে।

সেখানেই ক্ষান্ত হননি তিনি। বিলবাওকে নিয়ে গিয়েছিলেন কোপা দেল রে-এর ফাইনাল অবধি। তিনি যেন জাদুই জানতেন। তাইতো ডিয়েগো সিমিওনি, মাউরিসিও পচেত্তিনোর মত কোচরাও গুরু মানেন মার্সেলো বিয়েলসাকে। না মেনে নেওয়ার তো আর উপায় নেই। তিনি তো সবার থেকেই ভিন্ন। তাঁর ফুটবলীয় দর্শন বাকি সবার চাইতেই আলাদা।

তিনি প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের যেন একটা ফোঁটা সুযোগ দিতে চাননা মাঠের ফুটবলে। তিনি যেন বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে নারাজ। দ্রুত খেলার গতি পরিবর্তন করার দীক্ষাটা তিনি ভাল করেই শিখিয়ে দেন নিজের শীর্ষ্যদের। তরুণ ফুটবলারদের আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতেও যেন তাঁর জুড়ি মেলা ভার। বিপ্লবী এক ফুটবল গুরু।

একজন ভাল মানের ফুটবল কোচ হওয়ার পাশাপাশি তিনি যে একজন উঁচু মানের মানুষ সেটার প্রমাণটাও তিনি দিয়েছিলেন ফুটবলের সবুজ গালিচায়। ২০১৯ সালে অ্যাস্টন ভিলার বিপক্ষে ইনজুরির সুবিধা নিয়ে গোল করে বসে লিডস ইউনাইটেড। বিয়েলসা তাঁর শীর্ষ্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন অ্যাস্টন ভিলাকে বিনা বাধায় একটি গোল করার সুযোগ করে দিতে। সে নিয়ে পুরো বিশ্ব ফুটবলের নানান রকম আলোচনা হয়েছিল একটা লম্বা সময় জুড়ে।

তবে এত সব সাফল্যের মাঝেও কালিমার দাগ যে লাগেনি মার্সেলোর বিয়েলসার গায়ে তা কিন্তু নয়। নানান সময়ে তিনি ভিন্ন সব ক্লাব থেকে হয়েছেন বিতারিত। তবুও নিজের স্বমহীমায় ফুটবলের এক উজ্জ্বল তারকা হয়েই রয়ে যাবেন মার্সেলো বিয়েলসা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link