২০০৫ অ্যাশেজ ও ম্যাকগ্রা: একটি আঙ্কিক বিশ্লেষণ

ম্যাকগ্রার অনুপস্থিতিতে এই সময়কালে হওয়া ১৯ টেস্টে অস্ট্রেলিয়া জেতে ১৩ টি, হারে দুটি এবং ড্র হয় চারটি। জয়ের শতাংশ কম ম্যাচেও ৬৮.৪২%। ম্যাকগ্রার অনুপস্থিতিতে যথাক্রমে লি, গিলেস্পি এবং ওয়ার্নের গড় দাঁড়িয়েছে ৩৮.০৫, ২৫.৫৭ ও ২১.৯৮। গিলেস্পির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে কিছু ভালো পারফরম্যান্স বাদ দিলে গড় গিয়ে দাঁড়ায় ৩০.৬৯ তে। একমাত্র ওয়ার্ন ম্যাকগ্রার অনুপস্থিতিতে কম গড়ে বেশি উইকেট তুলেছেন এবং সেটাই স্বাভাবিক। এই পরিসংখ্যান দুটো চরম সত্য দেখাচ্ছে। এক, ফাস্ট বোলাররা জুটিতে লোটেন। এবং দুই, এজবাস্টন টেস্টের সকালে ম্যাকগ্রা চোট না পেলে মাইকেল ভন জাতীয় নায়ক হতে পারতেন কিনা সন্দেহ।

২০০৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। এইদিনে ইংল্যান্ড ১৬ বছর পর অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করে। সেই জয়ের পর অধিনায়ক মাইকেল ভন হয়ে ওঠেন জাতীয় নায়ক। বিলেতে ক্রিকেট নিয়ে আবেগের যে লাভাস্রোত উদ্গিরণ তার একমাত্র তুলনা হতে পারে অর্থনৈতিক মন্দাক্রান্ত ১৯৮১ সালে বিলাতে স্যার ইয়ান বোথামের অ্যাশেজ জয়। এই জয় নি:সন্দেহে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। কিন্তু একটু ভেতরে গিয়ে দেখতে গিয়ে কিছু তথ্য পেলাম, যা একটু হলেও সেই জয়ের চকমকি পাথরের রোশনাই কমিয়ে দেয়।

সেই সিরিজে ইংল্যান্ড দুটি টেস্ট জেতে, একটি হারে এবং একটি ড্র হয়। আশ্চর্য্যের ব্যাপার, যে দুটি ম্যাচ ইংল্যান্ড জেতে, সেই দুটি ম্যাচেই গ্লেন ম্যাকগ্রা নামক একজন অনুপস্থিত ছিলেন। ম্যাকগ্রা খেলেন তিনটি টেস্টে, লর্ডস, ওল্ড ট্রাফোর্ড ও ওভালে। এর মধ্যে লর্ডসে ইংল্যান্ড গোহারান হারে। ওল্ড ট্রাফোর্ডে অস্ট্রেলিয়া হারতে হারতে ড্র করে এবং ওভালে কেভিন পিটারসেনের অনবদ্য ১৫৮ ম্যাচ ড্র করায়।

ম্যাকগ্রার খেলা এবং না খেলার মধ্যে পার্থক্যটা একবার কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে দেখে নি। ম্যাকগ্রা নিজে যে তিনটি ম্যাচ খেলেন, সেই তিনটিতে তিনি ২৩.১৫ গড়ে ১৯ উইকেট পান। এবং সেই ম্যাচগুলোতে লি ১১ উইকেট পান ৪০.৬৪ গড়ে, ওয়ার্ন ২২ উইকেট পান ২২.৮২ গড়ে এবং ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে আসা জেসন গিলেস্পি ১ উইকেট পান ১৮৫ রানে।

ম্যাকগ্রাবিহীন দুটি ম্যাচে লি ৯ উইকেট পান ৪১.৬৭ গড়ে, ম্যাকগ্রার বদলি মাইকেল ক্যাসপ্রভিজ ৪ উইকেট পান ৬২.৫০ গড়ে, গিলেস্পি পান ২ উইকেট ৫৭.৫০ গড়ে, ওয়ার্ন ১৬.৩৯ গড়ে পান ১৮ উইকেট। যদি গিলেস্পির পরিসংখ্যান হটিয়ে দি (যেহেতু দুক্ষেত্রেই গড় ৫০ এর ওপর) একমাত্র ওয়ার্ন ম্যাকগ্রার অনুপস্থিতিতে ভালো বল করেছেন ম্যাকগ্রা উপস্থিত থাকা ম্যাচগুলোর তুলনায়।

শুধু গড় নয়, ম্যাকগ্রার উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতিতে বড়ো পার্থক্য রয়েছে ইংল্যান্ডের ওভার প্রতি রানেও। ম্যাকগ্রার উপস্থিতিতে ইংল্যান্ডের রানরেট ৩.৬৯ ও গড় ৩১.৫৫। বাকি দুই টেস্টে ইংল্যান্ডের রানরেট ৪.১৭ ও গড় ৩২.৩০। অর্থাৎ ওভার প্রতি প্রায় ০.৪৮ রানের পার্থক্য। যা দেখতে ছোট হলেও বড়ো ক্যানভাসে অনেক বেশি তফাৎ গড়ে দিতে পারে।

এবার একবার ম্যাকগ্রার উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিতে অজি বোলারদের ওয়ার্কলোডের পার্থক্য টা দেখেনি। লর্ডস, ওভাল ও ম্যানচেস্টারে মিলিয়ে ম্যাকগ্রা একাই করেন ২৭.৯৩% ওভার, লি ২৩.৪৪% ও ওয়ার্ন ৩৩.৭০% । সেখানে বাকি দুই টেস্টে ব্রেট লিকেই পেসারদের মধ্যে ওয়ার্কলোডের সিংহভাগ বহন করতে হয়। লি সেই দুই টেস্ট মিলিয়ে করেন ২৭.৫৯% ওভার, ওয়ার্ন ৩১.৮৯% ওভার এবং যেটা আশ্চর্য্যের, সেই দুই ম্যাচে ম্যাকগ্রার বদলি হিসেবে নামা মাইকেল ক্যাসপ্রভিজ করেন মাত্র ১৮.১৬% ওভার।

গিলেস্পি ও শন টেইট মিলে মিশে ম্যাকগ্রার উপস্থিতিতে হওয়া টেস্ট গুলোয় করেন মাত্র ১১.৯২ % ওভার। এবং বাকি দুই টেস্টে ২০.২৬% ওভার। একটা সাধারণ ৯০ ওভারের দিনে, তিন পেসার ও এক স্পিনার নিয়ে গড়া আক্রমণের অধিনায়ক আশা করবেন যে তাঁর স্পিনার দিনে অন্তত ৩০% ওভার বল করবেন (২৭ ওভার) এবং বাকি তিন পেসার মিলে শ্রমের সমবন্টনের হিসাবে ২১ ওভার (২৩.৩৩%) করে করবেন।

কিন্তু, এই তিনজনের মধ্যে একজন বা দুজন যদি খারাপ ফর্মে থাকেন, এবং উইকেট না পেয়ে রান বিলিয়ে যেতেই থাকেন, তবে বাকি বোলারদের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বল করতেই হবে। এবং দুই স্পেলের মাঝে যথেষ্ট বিশ্রাম না পাওয়া বোলার ঠিক ততটা ধারালো হয়ে দেখা দেবেন না।

গিলেস্পি ও ম্যাকগ্রার বদলি ক্যাসপ্রভিজের খারাপ ফর্ম এবং টেটের অনভিজ্ঞতাকে পন্টিংয়ের তাঁদের প্রতি ভরসাহীনতা এবং প্রকারান্তরে কম বল দেওয়ার কারণ হিসাবে দর্শানো যায়। এবং এর ফলে বাকি বোলারদের ওয়ার্কলোড অনেকটাই বর্ধিত হয়। কাজেই কথাটি স্বচ্ছন্দ্যে বলা যায় যে শুধু ম্যাকগ্রার অনুপস্থিতি নয়, অস্ট্রেলিয়াকে সেবার ভুগিয়েছিলো তৃতীয় ও চতুর্থ পেসারের খারাপ ফর্মও।

শেষ করি আরেকটা পরিসংখ্যান দিয়ে। ২০০৩ এর পয়লা জানুয়ারি থেকে ম্যাকগ্রার অবসরের আগে পর্যন্ত, ম্যাকগ্রার উপস্থিতিতে যে সব টেস্ট ম্যাচ খেলা হয়, তাতে গিলেস্পির গড় ২৭.৮০, লির ৩০.৬৩, ওয়ার্নের ২৬.০৬ এবং স্বয়ং ম্যাকগ্রার ২২.১৯। এই সময় ম্যাকগ্রা যে ৩৩ টেস্ট খেলেছেন তাতে অস্ট্রেলিয়া জিতেছে ২৫টি, হেরেছে ২টি এবং ড্র হয়েছে ৬ টি ম্যাচ। জয়ের শতাংশ ৭৫.৭৫%।

ম্যাকগ্রার অনুপস্থিতিতে এই সময়কালে হওয়া ১৯ টেস্টে অস্ট্রেলিয়া জেতে ১৩ টি, হারে দুটি এবং ড্র হয় চারটি। জয়ের শতাংশ কম ম্যাচেও ৬৮.৪২%। ম্যাকগ্রার অনুপস্থিতিতে যথাক্রমে লি, গিলেস্পি এবং ওয়ার্নের গড় দাঁড়িয়েছে ৩৮.০৫, ২৫.৫৭ ও ২১.৯৮।

গিলেস্পির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে কিছু ভালো পারফরম্যান্স বাদ দিলে গড় গিয়ে দাঁড়ায় ৩০.৬৯ তে। একমাত্র ওয়ার্ন ম্যাকগ্রার অনুপস্থিতিতে কম গড়ে বেশি উইকেট তুলেছেন এবং সেটাই স্বাভাবিক। এই পরিসংখ্যান দুটো চরম সত্য দেখাচ্ছে। এক, ফাস্ট বোলাররা জুটিতে লোটেন। এবং দুই, এজবাস্টন টেস্টের সকালে ম্যাকগ্রা চোট না পেলে মাইকেল ভন জাতীয় নায়ক হতে পারতেন কিনা সন্দেহ।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...