পল স্কোলস, ব্রেইন অব ফুটবল!

দৈহিক গড়নে পল স্কোলস ছিলেন বেশ ছোট খাটো। এমনকি প্রথম দেখায় স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন অবশ্য তাকে বামন বলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এমনকি ক্লাবে সুযোগ দিতে রাজি হননি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই কিংবদন্তি কোচ বুঝতে পারেন তার জহুরি চোখ আসলে সেদিন কত বড় ভুল করেছে।

চামড়ার তৈরি ফুটবল নামের গোলকে আলতো ছোঁয়াতেই দর্শকদের মুগ্ধ করে দিতে পারে এমন খেলোয়াড়ের দেখা খুব কমই মিলেছে। গোলের এই লড়াইয়ে স্ট্রাইকার আর গোলরক্ষককে নিয়েই যত উচ্ছ্বাস। তবে নিজের প্রতিটি স্পর্শে পুরো খেলা নিয়ন্ত্রণ করা মিডফিল্ডাররা মাঠের চালিকা শক্তি; অনস্বীকার্য সৌন্দর্য।

আর এই অনস্বীকার্য সৌন্দর্যের অন্যতম স্রষ্টা ছিলেন পল স্কোলস। ইংল্যান্ডের শহর সালফোর্ডে জন্ম হয়েছিল স্কোলসের। শিল্প বিপ্লবের শুরুতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছিল সালফোর্ড। আবার পল স্কোলসকে লালন করে ফুটবল বিপ্লবেও অংশ নিয়েছিল শহরটি। 

পল স্কোলসের প্রথম ফুটবল খেলা শুরু হয় ল্যাঙলে ফুরোর হয়ে। পরবর্তীতে ল্যাঙলে আরসি স্কুলে ভর্তি হওয়ায় তাঁদের হয়ে খেলতে শুরু করেন তিনি। ক্রিকেট আর ফুটবল দুইটি খেলাতেই পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও স্কোলসের জন্য বিধাতা লিখে রেখেছিলেন ফুটবল। তাই ১১ বছর বয়সে পেশাদার ক্লাব ওল্ডহ্যাম সকারে যোগ দেন তিনি। 

স্থানীয় দলগুলোর হয়ে খেলার সময় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্কাউটদের নজরে এসেছিল পল স্কোলসের ফুটবলীয় প্রতিভা।সে সময়কার  ইউনাইটেড স্কাউট ব্রায়ান কিড তাঁকে ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ বলে অভিহিত করেন। তাই শীঘ্রই ইংলিশ ক্লাবটি কিশোর পল স্কোলসকে নিজেদের একাডেমিতে নিয়ে আসে।  

দৈহিক গড়নে পল স্কোলস ছিলেন বেশ ছোট খাটো। এমনকি প্রথম দেখায় স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন অবশ্য তাকে বামন বলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এমনকি ক্লাবে সুযোগ দিতে রাজি হননি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই কিংবদন্তি কোচ বুঝতে পারেন তার জহুরি চোখ আসলে সেদিন কত বড় ভুল করেছে। মাত্র পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির শরীর নিয়েই ওল্ড ট্র্যাফোর্ড দাঁপিয়ে বেড়াতে শুরু করেন স্কোলস।  

১৯৯৪ সালে অভিষেক হয় পল রেড ডেভিলদের মূল দলে অভিষেক হয় পল স্কোলসের। শুরুতে দলের নাম্বার টেন জার্সি দেয়া হয় তাকে। সে সময় অবশ্য তিনি স্ট্রাইকার, আর ফলস নাইন পজিশনে খেলতেন। অভিষেক মৌসুমে শুরুর একাদশে খুব একটা সুযোগ না পেলেও পরের মৌসুমে মার্ক হিউজ চেলসিতে চলে যাওয়ায় কোচের প্রথম পছন্দ হয়ে ওঠেন এই ইংরেজ।                                                                                                  

সেবার পুরো মৌসুমে ১৪ গোল করেন পল স্কোলস। দুর্দান্ত সব হেড করে নিজের শারিরীক প্রতিবন্ধকতাকে রীতিমত বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেন তিনি। সেই সিজনে তার জার্সি নম্বর বদলে ১৮ করে দেয়া হয়। আর এটিই পরবর্তীতে ট্রেডমার্ক পল স্কোলস ১৮ হয়ে ওঠে।  

নিয়মিত মিডফিল্ডার রয় কিন ইনজুরিতে পড়ায় মেক-শিফট মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতে শুরু করেন পল স্কোলস। কিন্তু মেক-শিফট হওয়া সত্ত্বেও বল নিয়ন্ত্রণ, পাসিং আর ম্যাচ রিড করতে পারার ক্ষমতা দিয়ে সবাইকে অবাক করে দেন স্কোলস। আর তাই পরবর্তীতে রয় কিন ফিরলে তাঁর সাথেই জুটি গড়ে মিডফিল্ডে খেলতে শুরু করেন তিনি। এরপর থেকে ফরোয়ার্ড স্কোলসকে ভুলে গিয়ে সবাই মেতে ওঠে মিডফিল্ড মায়েস্ত্রো স্কোলসের নিপুণতায়। 

দীর্ঘ পনেরো বছর ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন পল স্কোলস, এরপর তুলে রাখেন নিজের বুটজোড়া। কিন্তু সেটিই সমাপ্তি ছিল না; অবসর থেকে ফিরে এসে আরও একবার ইউনাইটেডবাসীকে প্রিমিয়ার লিগ উদযাপনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। সব মিলিয়ে লাল জার্সিতে মোট ৭০৯ ম্যাচে ১৫৩টি গোল করেছেন তিনি, এছাড়া অ্যাসিস্ট করেছেন ৭৫টি। 

পল স্কোলস ছিলেন ক্লাস অব ৯২-এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আর তাই হয়তো ক্যারিয়ারে অপূর্ণতা নেই। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, প্রিমিয়ার লিগ, এফএ কাপ, লিগ কাপসহ সম্ভাব্য সব ট্রফি জেতা হয়েছে তাঁর। ডিপ লায়িং প্লে-মেকার হিসেবে খেলোয়াড়ী জীবনের অধিকাংশ সময় কাটানো স্কোলসের নিঁখুত পাসিং দক্ষতা ছিল ঈর্ষণীয়।

কথিত আছে, পল নাকি প্রায়ই ৪০ ইয়ার্ড দূরের এক গাছ দেখিয়ে বলতাম আমি এখন এটা হিট করব এবং তিনি সেটা অনায়সে করতে পারতেন। তার পাসিং এর এই ক্ষমতার জন্য তাকে ‘Sat-nav’ হিসেবে ডাকা হত। আর এজন্য হয়ত তৎকালীন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে থামানোর জন্য ওয়েইন রুনি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো কিংবা রয় কিন নয়, থামাতে হতো পল স্কোলসকে। তিনিই মূলত রেড ডেভিলদের স্তম্ভ।  

থিয়েরি অঁরির কাছে পল স্কোলস ছিলেন প্রিমিয়ার লিগের সেরা ফুটবলার। আর জিনেদিন জিদানের চোখে বিশ্বসেরা একজন। পেলে, জর্জ বেস্ট, জাভির মত কিংবদন্তিরাও একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছে এই ব্রিটিশের শ্রেষ্ঠত্ব।

পল স্কোলস কখনোই দ্রুতগামী ফুটবলার ছিলেন না, এমনকি দলের সবচেয়ে শক্তিশালী কিংবা ফিট সদস্যও ছিলেন না। তারপরও তিনি সেরাদের একজন, কারন পায়ের খেলা ফুটবলটা স্কোলস খেলতেন মাথা দিয়ে। না তিনি, মাথায় বল জাগল করতেন ব্যাপারটি এমন নয়, তিনি বুদ্ধি দিয়েই বলকে আপন করে নিয়েছিলেন।  

আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে বেশ অল্প বয়সেই অবসর নিয়েছিলেন পল স্কোলস। তাই জাতীয় দলকে তেমন কিছু দিতে পারেননি, তবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড পেয়েছে তাঁর শতভাগ। নিজের ভাল সময়ে স্কোলস ছিলেন গ্রহের সেরা মিডফিল্ডার; এমনকি খারাপ সময়েও তিনি পিচের সেরা পারফর্মার ছিলেন। 

‘A screamer from Paul Scholes’ – ধারাভাষ্যকারের বলা এই একটি লাইন স্কোলসের ক্যারিয়ারকে বর্ণনা করে। পুরো জীবন জুড়েই পায়ের জাদুতে পুলকিত করেছেন সবাইকে। পেপ গার্দিওলার মতে, মাঝ মাঠে তাঁদের সময়ে এই স্কোলসই সেরা।

তিনি পল স্কোলস; তিনি ‘দ্য ব্রেইন অব ফুটবল। তিনি থাকবেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ইতিহাসে, তাঁর নাম থাকবে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের সবুজ ঘাসে। আর হ্যাঁ, তিনি থাকবেন রেফারির সেই বুকপকেটের ছোট্ট নোটবুকেও। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link