আপনার ভেতরে জেদ থাকতে পারে। ভাল কিছু অর্জন করতে আপনি বাড়তি পরিশ্রম করতে পারেন; প্রিয় কোন বস্তুর মায়া ছাড়তে পারেন। কিন্তু সেটা কতটা, জেদের সর্বোচ্চ পর্যায় কি হতে পারে – তারই একটা উদাহরণ পাওয়া যাবে ভারতীয় ক্রিকেটারের জীবনের দিকে তাকালে। তিনি কুমার কার্তিক – বাঁ-হাতি অফ স্পিনার।
এতদিনে কুমার কার্তিকের জেদের গল্প জানা হয়ে গিয়েছে সবার। অদম্য আগ্রহের কারণে নিজের লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই শেষমেশ ঘরের ছেলে ফিরে এলেন ঘরে। দীর্ঘ নয় বছর তিন মাস পর মায়ের কোলে ফিরলেন। টুইটারে নিজের অ্যাকাউন্টে পোস্ট দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন কার্তিক।
বয়সটা তখন ১৫, ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর কুমার কার্তিক। মনে হতে পারে এ আর এমনকি, যেখানে অলিতে-গলিতে খুঁজলে এমন শতশত ছেলে পাওয়া যাবে যারা ক্রিকেটার হতে চায়। কিন্তু কার্তিক তো আর সবার মত নয়; তাঁর ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছে শুধু অলীক স্বপ্ন ছিল না, ছিল দৃঢ় মনোবল। ব্যাটে বলের লড়াইয়ের একজন যোদ্ধা হওয়ার সাধনায় নিজেকে সঁপে দিলেন তিনি।
দশ বছর আগের কথা – সাধনা আর জেদের বশে কুমার কার্তিক সবসময় লেগে রইলেন অনুশীলনে। তিনি যে ক্রিকেটের পাগল, তা বোঝার জন্য এই যথেষ্ট। কিন্তু গল্পটা তখন মাত্র শুরু; এক বছর পরে ক্রিকেটে নিজেকে পুরোপুরি উজাড় করে দেয়ার জন্য বাড়ি ছাড়লেন। আর সেসময় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন প্রতিষ্ঠিত হতে না পারলে আর বাড়ি যাবেন না।
এই ছেদ, এই শুভ্রতার সাধনা – বিধাতা নিরাশ করেনি ১৫ বছর বয়সের কুমার কার্তিককে। ক্রিকেট কোচ ভরদ্বাজের একাডেমিতে ট্রায়ালের সুযোগ পান তিনি। মাত্র একটা ডেলিভারি দেখেই বিনামূল্যে সেই একাডেমিতে কার্তিককে ভর্তি করে নেন নির্বাচকরা। বিনামূল্যে ক্রিকেট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হলেও বাকি ছিল থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা।
তাই বাধ্য হয়েই ৮০ কিলোমিটার দূরে একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ নেন কুমার কার্তিক। সকালে একাডেমিতে ক্রিকেটের তালিম নেয়ার পর চলে যেতেন সকালে, রাতে সেখানেই ঘুমাতেন। দুপুরে ভাত জোগাড় করতে পারতেন না তিনি, বাধ্য হয়ে দশ রুপি দিয়ে বিস্কুট কিনে খেতেন। আর এই দশ রুপি বাঁচাতে মাইলের পর মাইল হেঁটে পাড়ি দিতেন এই বামহাতি।
পরে অবশ্য কোচ ভরদ্বাজ কুমারের এমন কষ্টের কথা জানতে পারেন। একাডেমিতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন তিনি, দীর্ঘ এক বছর সেখানে প্রথমবার দুপুরে ভাত খেতে পান কার্তিক।
২০২২ সালের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের দল মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন কুমার কার্তিক। এরপরই তাঁর এমন ত্যাগের গল্প সবার সামনে আসে।
কুমার কার্তিক ক্যারিয়ারের শুরুতে বামহাতি অফ স্পিনার হিসেবেই বোলিং করতেন। কিন্তু মুম্বাইয়ের স্কোয়াডে জায়গা পাওয়ার পরেই বামহাতি রিস্ট স্পিনার হয়ে উঠেন তিনি। এটিই ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম বেক থ্রু।
চেন্নাই সুপার কিংসের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আইপিএলে অভিষেক হয় তাঁর। সবমিলিয়ে পুরো আসরে চার ম্যাচ খেলে কার্তিক নিয়েছিলেন পাঁচ উইকেট, রান খরচের ক্ষেত্রেও টি-টোয়েন্টির হিসেবে বেশ সতর্ক তিনি। আইপিএলে এই ক্রিকেটার ওভার প্রতি ৭.৮৫ রান দিয়েছেন।
আইপিএল কুমার কার্তিককে পরিচিতি এনে দিলেও তাঁর মূল লক্ষ্য অর্জন হয়েছে রঞ্জি ট্রফি জয়ের মধ্য দিয়ে। মধ্যপ্রদেশের হয়ে ফাইনালে মুম্বাইয়ের বিপক্ষে পাঁচ উইকেট শিকার করে দলকে শিরোপা জেতাতে অবদান রাখেন। এছাড়া পুরো আসরে ৩২ উইকেট তুলে নিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক বোলার হয়েছিলেন।
‘স্বপ্ন সেটা নয় যেটা মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে, স্বপ্ন সেটাই যেটা পূরণের প্রত্যাশা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।’ – ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের এমন উক্তি কুমার কার্তিকের জন্য একটু বেশিই সত্যি। তবে শ্রেষ্ঠত্বের পথটা আরো অনেকটা দূর; আশা করা যায়, সহসাই থামবেন না চব্বিশ বছর বয়সী এই স্বপ্নবাজ।