সম্রাটের মহাদেশ বিজয়ের গল্প

২০০৪ সাল। কোপা আমেরিকার ৪১ তম সংস্করণের ফাইনাল। একে তো মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই, তার ওপর অন্তিম লড়াইয়ে মুখোমুখি ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। উত্তেজনার পারদ কোন চূড়ায় উঠেছিল – সেটা নিশ্চয়ই অনুমান করাই যায়।

টানটান উত্তেজনাপূর্ণ সেই ফাইনালে নির্ধারিত সময়ে ম্যাচ ড্র হয়। টাইব্রেকারে ৪-২ ব্যবধানে ম্যাচ জিতে নেয় ব্রাজিলই। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে শুট আউটে টুর্নামেন্ট জিতে ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো সেবার একই সাথে পরপর ফিফা বিশ্বকাপ ও কোপা আমেরিকার শিরোপা ঘরে তুলেছিলো ব্রাজিল। আর সেই বার কোপা আমেরিকা জয়ের নেপথ্যের নায়ক ছিলেন আঁধারের সম্রাট। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন – আদ্রিয়ানো। 

পুরো নাম আদ্রিয়ানো লেইতে রিবেইরো। ভক্তদের কাছে ‘লিম্পেরাতোরে’ ডাকনামে পরিচিত ছিলেন। যার বাংলা অর্থ করলে দাড়ায় ‘সম্রাট’। তাঁর সময়কালে তিনি ফুটবলের সম্রাটই ছিলেন বটে। ব্রাজিলের এই স্ট্রাইকারের জাতীয় দলে অভিষেক ঘটে ২০০০ সালে আঠারো বছর বয়সে।

রোনালদোর অনুপস্থিতিতে তিনি ২০০৪ সালে কোপা আমেরিকায় ব্রাজিলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই বার সাত গোল করে প্রতিযোগিতার শীর্ষস্থানীয় স্কোরার হিসেবে গোল্ডেন বুট পেয়েছিলেন আদ্রিয়ানো। আদ্রিয়ানোকে মানা হতো রোনালদোর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে। কারণ আদ্রিয়ানোর খেলার ধরনের সাথে তরুণ বয়সের রোনালদোর খেলার ধরনের বেশ মিল ছিল। 

কোপা আমেরিকার সেই ফাইনাল ম্যাচে আদ্রিয়ানো শুরু থেকেই আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডারদের ঘাম ঝরাতে লাগলেন। জমজমাট সেই ম্যাচে ৮৭ মিনিটে গোল খেয়ে ব্রাজিল যখন ২১ গোলে পিছিয়ে পড়লো তখন মনেই হচ্ছিল এই বুঝি ম্যাচটি হাতছাড়া হয়ে গেল।

ইনজুরি টাইমে খেলার সময় নষ্ট হওয়ার কারণে স্টপেজের জন্য যখন তিন মিনিট যোগ করা হয়েছিল। ঠিক সেই অন্তিম মুহুর্তে গোল করে ব্রাজিলকে নাটকীয়ভাবে সমতা এনে দেন আদ্রিয়ানো। ফলে ম্যাচটি টাইব্রেকারে গড়ায়। ব্রাজিল শেষ পর্যন্ত ৪-২ ব্যবধানে জয়লাভ করে, আদ্রিয়ানো তার পেনাল্টিতে আরেকটি গোল করেন। ম্যাচের পরে, কোচ কার্লোস আলবার্তো পেরেইরা শিরোপা জয়ের জন্য আদ্রিয়ানোকে ত্রাণকর্তা হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন।

ম্যাচের পর ব্রাজিলের ফুটবলের নতুন নায়ক আদ্রিয়ানো তাঁর অনুভূতি জানিয়েছিলেন এভাবে যে, ‘আমি এখন কেমন অনুভব করছি তা আমি বলে বোঝাতে পারবো না। এটা অবশ্যই আমার ক্যারিয়ারের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত।’

আসলেই ২০০৪ সালের কোপা আমেরিকা ছিল আদ্রিয়ানোর ক্যারিয়ারের স্বর্ণালি সময়। ব্রাজিলের জার্সি গায়ে আদ্রিয়ানো সর্বমোট ৪৮ ম্যাচে ২৭টি গোল করেছিলেন। কিন্তু আদ্রিয়ানোর ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ সময় বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আদ্রিয়ানোর বিশ্বসেরা হওয়ার সম্ভাবনা দুর্ভাগ্যক্রমে দ্রুতই মিইয়ে যায়।

কোপা আমেরিকার ফাইনালের পরপরই আদ্রিয়ানোর বাবা মাত্র ৪৫ বছর বয়সে মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার পর প্রথম প্রথম সব ঠিকঠাকই চলছিল। আদ্রিয়ানো দারুণ খেলাটা ও গোল করাটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এই মানুষটিই যে ভেতরে ভেতরে তাঁর জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষের চলে যাওয়ার শোকে মিইয়ে যাচ্ছিলেন তা কেউ টের পায়নি।

বাবাকে হারিয়ে নিদারুণ নি:সঙ্গ জীবনে সঙ্গী করে নিয়েছিলেন মদ্যপানকে। এই অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের প্রভাব আস্তে আস্তে আদ্রিয়ানোর ক্যারিয়ারের উপর পড়তে লাগলো। নিজের ফুটবলীয় প্রতিভাটাই খুইয়ে যেতে বসেছিলেন।

মদ্যপানের কুপ্রভাবটা ভালোভাবে টের পাওয়া গেলো ২০০৬ বিশ্বকাপে। আগের দুটি টুর্নামেন্টে যে খেলোয়াড় একাই গোল্ডেন বুট ও গোল্ডেন বল জিতেছিলেন, তাকে নিয়ে বিশ্বকাপে বড় আশা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই বিশ্বকাপে আদ্রিয়ানো দুটি গোল করলেও, তাকে নিয়ে সবার প্রত্যাশার ছিটেফোঁটাও তিনি সেবার পূরণ করতে পারেননি!

লাগামহীন জীবনযাপনে ওজন বেড়ে ফিটনেস হারিয়ে ফেলেছিলেন। ক্লাব পারফরম্যান্সও দিনদিন অবনতি হচ্ছিল। যার কারণে ক্লাব বদল করতে বাধ্য হয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে ২০১০ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে খেলার সুযোগ পেলেও তাঁর খামখেয়ালী স্বভাবের জন্য দলে আর জায়গা পাননি।

ওদিকে কোন ক্লাবেই ঠিকঠাক থিতু হতে পারছিলেন না পারফরম্যান্স দিয়ে। একটা সময় ফুটবলের প্রতিই ভালোবাসাটা হারিয়ে ফেলেন এই ফুটবল সম্রাট। ফুটবলবিশ্বের দারুণ এক সম্ভাবনাময়ী প্রতিভার বড্ড অপচয় হয়ে যায় আদ্রিয়ানোর অবসরের সাথে সাথে। এখন আর সম্রাট নন, আঁধারের সম্রাট হয়েই টিকে আছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link