ঠাকুরমার ঝুলির সেই রূপকথার কেচ্ছা শৈশবে শুনেছিলাম মায়ের মুখে। রাজপুত্র ডালিমকুমার কিভাবে রাক্ষসের হাত থেকে উদ্ধার করেছিল রাজকন্যাকে! সেটা যতবার শুনতাম, ততবারই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠত! ভয়, শিহরণ আর রোমাঞ্চে ভেসে ডালিম কুমারের চেহারা কল্পনা করতাম।
ঘুমাতে যাবার আগে নিজেকে ডালিম কুমারের জায়গায় কতবার ভেবেছি! আসলে সবাই ডালিমকুমার হতে চায়, কিন্তু কতজন পারে সেই রূপকথার ডালিম কুমার হতে? শৈশবের সেই ডালিমকুমার বয়সের সাথে সাথে হারিয়ে যায় স্মৃতির অতলে, আর বাস্তবের কিছু ডালিম কুমার জায়গা করে নেয় হৃদয়ে।
আজ থেকে প্রায় তিন যুগেরও বেশি সময় আগের ক্রিকেটকে যদি আপনি রুপকথা ধরেন এবং ইংলিশ ক্রিকেট যদি সেই রুপকথার রাজকন্যা হয়, তাহলে সেখানে একজন ডালিমকুমার তো থাকবেনই! রাজকন্যাকে উদ্ধার করে ইতিহাসে অমর হবেন ডালিমকুমার, ক্রিকেট বিধাতা গল্পটা সেভাবেই সাজিয়েছিলেন।
১৯৮১ সালের জুলাই মাস, ইংল্যান্ডের মাঠে মর্যাদার অ্যাশেজ লড়াই। জুলাইয়ের ১৬ তারিখে ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেনসি তুলে দেয়া হল এক যুবকের হাতে। এমন সময়ে অধিনায়কত্ব পেলেন যখন দল সিরিজে পিছিয়ে আছে ১-০ ব্যবধানে। হাতে রয়েছে আর মাত্র তিনটি টেস্ট এবং পেছনে বিষের কলম হাতে ব্রিটিশ মিডিয়া!
প্রথমে ব্যাট করে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ ৪০১/৯! অধিনায়ক ছয়টি উইকেট পেলেন ঠিকই, কিন্তু অস্ট্রেলিয়া চড়ে বসলো রানের পাহাড়ে। জবাবে, ইংলিশ মিডিয়ার রুদ্ররূপ দেখতেই কিনা, ইংল্যান্ড অল আউট মাত্র ১৭৪ রানে। ক্যাপ্টেনের ফিফটি হল, তবে ফলো অন থেকে দলকে রক্ষা করতে পারলেন না।
ফলো অনে পড়ে দ্বিতীয় ইনিংসে কোথায় ভাল শুরু করবে ইংলিশ ব্যাটসম্যানেরা, কিন্তু না, দেখতে না দেখতেই স্কোর ১০৫/৫! সিরিজে সমতা তো দূরের কথা, ইনিংস পরাজয়ের চোখ রাঙানি আটকানোই মুশকিল! তরুণ অধিনায়ক তখনও ফুটো নৌকার হাল ধরে আছেন।
সদ্য দায়িত্ব নিয়েছেন, সিরিজের নাম অ্যাশেজ, দল ইনিংস পরাজয়ের সামনে! কি ভাবছিলেন তিনি সেদিন উইকেটে দাঁড়িয়ে? তিনি তখন ভাবছিলেন সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘if we go down, let’s go down burning।’
হ্যাঁ, তিনি জ্বললেন, আর সেই আগুনে পুড়ে ছাই হল সকল শঙ্কা, সকল দ্বিধা! ১৩৫/৭ থেকে ইংলিশদের স্কোর গিয়ে থামল ৩৫৬ রানে। ক্যাপ্টেন তখনও অপরাজিত ১৪৯ রানে! মাত্র ৮৭ বলে ছুঁয়েছিলেন শতক, মেরেছিলেন ২৭টি চার এবং একটি ছক্কা!
হ্যাঁ, তিনি জ্বলেছিলেন এবং সেই আগুনের দীপ্তিতে আলোকিত করেছিলেন সতীর্থদেরকেও, বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিলেন ফিনিক্স পাখির মত গা-ঝাড়া দিয়ে উঠতে। আর তাইতো, ১৩০ রানের জয়ের লক্ষ্য অস্ট্রেলিয়ার কাছে হয়ে উঠল পাহাড়সম। ১৮ রানে ম্যাচ জিতে গেল ইংলিশরা!
একজন অধিনায়কের ডালিম কুমার হয়ে ওঠার প্রথম অধ্যায় ছিল সেটা। তার ইনিংসকে অসংখ্য বিশেষণে বিশেষায়িত করেছে মিডিয়া, ফ্রন্ট পেজের পুরোটা জুরে চলেছে স্তব-স্তুতি। অথচ এটা তার সেরা ইনিংস ছিলই না। তার সেরা ইনিংস ছিল ঠিক তার এক টেস্ট পরেই।
সেই অ্যাশেজের শেষ টেস্টে ১৩ টি চার এবং ৬ টি ছক্কায় মাত্র ১০২ বলে ১১৮ রানের আরও একটি অতিমানবীয় ম্যাচজয়ী ইনিংসে ইংল্যান্ডকে এনে দেন ৩-১ ব্যবধানে সিরিজ জয়ের স্বাদ। ইংলিশ ক্রিকেটে অমরত্ব পেতে এর থেকেও বেশি কিছু করা যায় কিনা সেটা আমার জানা নেই, কিন্তু তরুণ নেতা রাতারাতি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি।
হেডিংলির রাজা বলা হত স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে। দু- দুটো ট্রিপল সেঞ্চুরি তিনি এখানে করেছিলেন! কিন্তু রাজাকেও কিছু ক্ষেত্রে সেনাপতির জন্য জায়গা করে দিয়ে পাশে সরে দাঁড়াতে হয়। হেডিংলির ওই মাঠ নি:সন্দেহে ওই তরুণ ক্যাপ্টেনের, একজন জাতীয় বীরের, যে কিনা নুয়ে পরা একটি দলকে উদ্ধার করেছিল। তার ক্যারিয়ার থেমেছিল ১০২ টেস্টে, রান করেছিলেন ৫২০০, উইকেট নিয়েছিলেন ৩৮৩টি।
পরিসংখ্যান ঠিক এখানেই আস্ত গাধা! ওই পরিসংখ্যানে লেখা নেই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পগুলো, ওই পরিসংখ্যানে লেখা নেই একটি অ্যাশেজ জয়ের মাহাত্ম্য, ওই পরিসংখ্যানের আয়নায় বোলাদের অসহায় মুখ দেখা যায় না, ওই পরিসংখ্যানে এক জাতীয় নায়ককে সঙ্গায়িত করা যায় না।
অনেকেই আন্দাজ করে নিয়েছেন এতক্ষনে নিশ্চয়ই। আন্দাজ না করতে পারলেই বরং বেশি বিস্মিত হব। ইংলিশ ক্রিকেটের ‘দ্য গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’ খেলোয়াড়টিকে না চেনা যে একজন ক্রিকেট ভক্তের জন্য একপ্রকার অপরাধের মতোই।
দ্য ওয়ান অ্যান্ড অনলি, দ্য লিজেন্ড অব ক্রিকেট, দ্য ন্যাশনাল হিরো অব ইংল্যান্ড, স্যার ইয়ান বোথাম! হ্যাঁ, হেডিংলির সেই ২২ গজের নায়ক, সেই তরুণ নেতা ছিলেন ইংল্যান্ডের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার স্যার বোথাম।
ইংরেজদের রূপকথার গল্পে রাজপুত্রের নাম কি আমি জানি না। হয়ত ইংলিশ কোন বালক আমার মতোই কোন ডালিম কুমারকে ভেবে ঘুমাতে যায়। অথবা, টিভি পর্দার ভার্চুয়াল কোন সুপার হিরোকে নিয়ে ভাবে, কিন্তু ক্রিকেটের সুপার হিরোর ভাবনায় ইংলিশদের মনে শুধু ওই একটাই নাম উচ্চারিত হয়।