সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল
সেই গিয়েছে সবার আগে সরে।
ছোট্ট যে জন ছিল রে সবার চেয়ে
সেই দিয়েছে সকল শূন্য করে।
—ছিন্নমুকুল; সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
চোখমুখে একটা দারুণ আদুরে ব্যাপার ছিল।
দলে সবার ছোট ছিলেন বলে সতীর্থরা একেবারে ছোট ভাইটার মতই ভালো বাসতেন। ডেভিড ওয়ার্নার আদর করে ‘লিটল মেট’ বলেই ডাকতেন। আর সেই ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট মহলে এক নামে লোকজন তাকে ডাকত—দ্য কিড; পিচ্চি।
নিয়তির কী নিষ্ঠুরতা, সেই আদরের দুলাল, অস্ট্রেলিয়ার প্রতিশ্রুতিশীল টেস্ট ক্রিকেটার, ‘পিচ্চি’ ফিলিপ জোয়েল হিউজ চলেই গেলেন সবার আগে; চলেই গেলেন ব্যাট-বলের এই তুচ্ছ পৃথিবীর বাঁধন কাটিয়ে। ২৬তম জন্মদিনের ঠিক তিন দিন আগে ‘বিদায়’ বলে দিয়েছিলেন নশ্বর দুনিয়াকে।
২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর শেফিল্ড শিল্ডের ম্যাচে শন অ্যাবটের বলে মাথায় আঘাত পাওয়ার পর দুই দিন ধরে লড়াই করেছিলেন সিডনির সেন্ট ভিনসেন্ট হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে। সেই আঘাতের পর আর একটি বারের জন্যও জ্ঞান ফিরে না আসা এই তরুণ ক্রিকেটার মাত্র ২৫ বছর বয়সে পরলোকে পাড়ি জমান আজকের দিনটাতে; ২৭ নভেম্বর।
ফিলিপ হিউজের মৃত্যুটা ঠিক একটা মৃত্যু ছিল না। অস্ট্রেলিয়ার জন্য, ক্রিকেটের জন্য এটা একটা বজ্রপাতের মত ব্যাপার ছিল।
হিউজকে যেদিন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, তারপর থেকে শেষ অবধি একটা মুহূর্তের জন্য হাসপাতাল ছেড়ে যাননি মাইকেল ক্লার্ক। ব্র্যাড হাডিন, স্টিভেন স্মিথ, শেন ওয়াটসন, ডেভিন ওয়ার্নার, নাথান লিওঁ, মিশেল স্টার্করা এই কটা দিন হাসপাতালেই যাতায়াতের মধ্যে ছিলেন। রিকি পন্টিং, স্টিভ ওয়াহ, সাইমন ক্যাটিচ, অ্যারন ফিঞ্চ, পিটার সিডল, জর্জ বেইলি, জাস্টিন ল্যাঙ্গার থেকে শুরু করে জাতীয় দলের কোচ ড্যারেন লেহম্যান বা ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী জেমস সাদারল্যান্ড ছিলেন হিউজের শেষ সময়টাতে।
না থেকে উপায় কী!
ফিলিপ হিউজ শুধু অস্ট্রেলিয়ার একজন উঠতি তারকাই ছিলেন না, ছিলেন সারা ক্রিকেট বিশ্বেরই এক সম্ভাবনাময় তারকা; মহাতারকা হয়ে ওঠারও সম্ভাবনা ছিল যার।
১৯৮৮ সালের ৩০ নভেম্বর নিউসাউথ ওয়েলসের ম্যাকসভিলে শহরে বাবা গ্রেগ ও মা ভার্জিনিয়া হিউজের ঘরে জন্মেছিলেন এই ভবিষ্যত অস্ট্রেলীয় তারকা। বাবার কলার খামারে বেড়ে উঠেছেন তিনি। সেখানেই বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট শুরু। একটু বড় হতেই হিউজকে গড়ে পিটে বড় করে তোলার দায়িত্ব নেন মাইকেল ক্লার্কের কোচ ডি কস্তা। এই ভদ্রলোকই মূলত হিউজকে ‘দ্য কিড’ বলে পরিচয় করিয়ে দেন।
২০০৯ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেক হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টেই অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরি করে বুঝিয়ে দেন- তিনি থাকতে এসেছেন। এরপর ক্যারিয়ারে কিছু উত্থান-পতন পার হতে হয়েছে হিউজকে। ২০১৩ সালে হয়েছে ওয়ানডে অভিষেক; একমাত্র অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে এই ফরম্যাটে অভিষেকেই সেঞ্চুরি করেছেন।
এবার বলা হচ্ছিল, ফিলিপ হিউজ নিজেকে স্থায়ী করতেই মাইকেল ক্লার্কের বদলে দলে আসছেন। আগমনী গানটা ওই সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডেই শোনাচ্ছিলেন। একের পর এক বাউন্সার সামলে, বল সীমানা ছাড়া করে ফিফটি পার করে গেলেন। ৬৩ রানে ব্যাট করতে থাকা হিউজ আরেকটা সেঞ্চুরির স্বপ্ন আটছিলেন হয়তো।
কিন্তু অ্যাবটের এবারের বাউন্সারটা কি ভেবে যেন পুল করতে গেলেন। ঘাড়ে বল লাগল, হেলমেট খুলে ফেললেন, পড়ে গেলেন সামনে মুখ করে; তারপর সব শেষ। সব স্বপ্ন, সব লক্ষ্য, সব গল্প থেমে গেল।
আসলেই কী হিউজের গল্প এখানে থেমে গেল? তাই কী হয়! ক্রিকেটের এই ‘পিচ্চি’ কী থেমে যেতে পারেন! ফিলিপ হিউজ থাকবেন না, থাকবেন তার বন্ধুরা। তার হয়ে ব্যাট করবেন, সেঞ্চুরি করবেন এবং অদৃশ্য এক কালিতে লেখা হবে—ফিলিপ হিউজ নট আউট।
আসলে কিছু মৃত্যু এমনই হয়; কিছু মৃত্যু থাকে, যার তীব্রতা আপনি প্রচলিত কোনো মাপকাঠি দিয়ে পরিমাপ করে উঠতে পারবেন না।
কিছু মৃত্যু আলাদা।
কথাটা আপাত দৃষ্টিতে একটু আপত্তিকর বলে মনে হতে পারে। প্রতিটি মৃত্যুই আসলে স্বজনদের জন্য অপরিসীম এক শোকের নাম। প্রতিটি মৃত্যুই আসলে এক মহাপ্রয়াণ। তারপরও এই মৃত্যুগুলো আলাদা হয়ে যায় তার ধরণের কারণে। এ যেন গান গাইতে গাইতে শিল্পীর মৃত্যু কিংবা ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে ‘কাট’ বলার আগেই পরিচালকের মৃত্যু!
এ হল আপন তীর্থে বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মত মৃত্যু।
এই মৃত্যু কতটা আলাদা, তা আপনি বুঝতে পারবেন অস্ট্রেলিয়াকে দিয়ে। আমরা অস্ট্রেলিয়ানদের ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ জাতি বলেই চিনি। এরা উইকেটে ব্যাটসম্যানদের রক্ত ঝরাতে ভয় পায় না। সেই জাতিই একটি মৃত্যুতে এতটা অসহায় হয়ে গেল!
আজও অবধি অস্ট্রেলিয়ানরা হিউজের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলে মনে হয় না। হিউজের শোক কাটিয়ে উঠতে না পারায় অস্ট্রেলিয়ানরা টেস্ট ম্যাচ পিছিয়ে দিয়েছিল!
অফিশিয়াল স্কোর বোর্ডে পরিবর্তন আনা, স্কোয়াডে অদৃশ্য হিউজকে রেখে দল ঘোষনা করা; এরকম সব কাণ্ড করেছে অস্ট্রেলিয়ানরা। এগুলো ‘অস্ট্রেলিয়ানিজম’-এর সাথে যেন যায় না। তাহলে অস্ট্রেলিয়া কেনো এত আচ্ছন্ন হয়ে গেল? কেনো আজ দুই বছর পরও এক হিউজের মৃত্যুর ঘোর থেকে বের হতে পারছে না তারা?
অস্ট্রেলিয়ান একটি সংবাদ মাধ্যম এর ভাল ব্যাখ্যা দিয়েছে—হিউজ ছিলেন ‘কান্ট্রিবয়’। জাতীয় দলে কী করেছেন, না করেছেন; এটা এখানে বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য হল, দেশের মানুষের ভালোবাসার সম্পদ।
এই জায়গাটায় আপনি হিউজ আর রানাকে এক করে ভাবতে পারেন; হ্যাঁ,আমাদের মানজারুল ইসলাম রানা।
একজন মানুষকে আপনি রোজ দেখছেন মাঠে আসতে, রোজ সকাল হলেই ছেলেটি ব্যাট-বল নিয়ে ঘাম ঝরাচ্ছে, টিভি খুললেই তাকে দেখছেন, সে আসলে তখন আর শুধু তার বাড়ির একটা ছেলে নয়, প্রতিটি ক্রিকেট দর্শকের পরিবারের অংশ হয়ে যায়।
প্রতিটি ক্রিকেটারের এক বর্ধিত অংশ হয়ে ওঠেন এরা। এরা আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে ঠিক তারকা নন। তবে আর্ন্তজাতিক জাতীয় ক্রিকেটের ‘পার্ট অ্যান্ড পার্সেল’ বলা যায়। মোদ্দা কথায়—এরা ক্রিকেটের ছেলে; ক্রিকেট ভালোবাসে, ক্রিকেট খায়, ক্রিকেট ঘুমায়। সেই ক্রিকেট মাঠে বা আরেকটু বড় করে বললে খেলার মাঠে এরকম একজন খেলাধুলার ঘরের ছেলের প্রয়ান আসলে আর দশটা মৃত্যুর থেকে ভিন্ন কিছুই হয়ে ওঠে।
এই মৃত্যুগুলো তাই যেন মৃত্যুর চেয়েও বেশি কিছু হয়ে ওঠে। এ হয়ে ওঠে এক অসীম শূন্যতার নাম।