নব্বইয়ের দশক, ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট দ্বৈরথের স্বর্ণালী সময়। ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ অবশ্য নতুন কিছু না। দুই দেশের বৈরিতায় মিশে যায় ক্রিকেটাররাও। অবশ্য সেসব ক্রিকেটীয় লড়াই যুগের পর যুগ আমাদের মোহাবিষ্ট করেই আসছে। তবে দুই দেশের বর্তমানে রাজনৈতিক-কূটনৈতিক বৈরিতা এমন পর্যায়ে যে আইসিসি’র কোনো ইভেন্ট বা এশিয়া কাপ না হলে একে অন্যের সঙ্গে খেলতে দেখার সম্ভাবনা খুবই কম।
ক্রিকেট মাঠে বর্তমানে তাই ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের দেখা মেলে কালেভদ্রে। এজন্য শচীন-শোয়েবের মতো বিখ্যাত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন আর তেমন দেখা যায় না। তাই এখনো ভারত পাকিস্তান লড়াইয়ে শোয়েব আক্তার-শচীন টেন্ডুলকার দ্বৈরথ এক নস্টালজিয়ার নাম।
এমনিতে ক্যারিয়ারে কখনোই নিয়মিত ক্রিকেটার ছিলেন না শোয়েব আখতার। মাঠের বাইরে বহু শৃঙ্খলতাজনিত সমস্যার কারণে ক্যারিয়ারে টানা ম্যাচ খেলেছেন কম। এজন্য বিধ্বংসী পেসার হওয়া স্বত্ত্বেও ক্যারিয়ার তেমন সমৃদ্ধ হয়নি। তবে প্রতিপক্ষ ভারত আসলেই যেন অন্য এক রূপে দেখা যেত শোয়েব আখতারকে।
বিশেষ করে ১৯৯৯ সালের এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে হওয়া এক ম্যাচে পরপর দুই বলে রাহুল দ্রাবিড় আর শচীন টেন্ডুলকারকে বোল্ড করার দৃশ্যটা সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়। সম্প্রতি শোয়েব আখতার তার করা সেই দুই ডেলিভারির স্মৃতিচারণা করেছেন৷ স্টার স্পোর্টসে হওয়া এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন ঐ দুই ডেলিভারির নেপথ্যের গল্প।
ভারত তখন প্রথম ইনিংসে ব্যাট করছে। প্রথম ইনিংসে পাকিস্তানের করা ১৮৫ রানের বিপরীতে ভারত তখন পর্যন্ত বেশ ভালভাবেই জবাব দিচ্ছিল। বড় লিডের পথেই চোখ ছিল তাদের। ইনিংসের ৫১ তম ওভার করতে আসলেন শোয়েব আখতার। স্টাইক প্রান্তে তখন ৯২ বলে ২৪ রানের ইনিংস খেলা রাহুল দ্রাবিড়। সাবলীল ব্যাটিং করছিলেন তিনি। পাকিস্তানের অধিনায়ক ওয়াসিম আকরাম অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করলেন যে, দ্রাবিড় প্রায় প্রত্যেকটা বলই ফ্রন্টফুটে ডিফেন্স করছেন। তিনি শোয়েব আখতারকে নির্দিষ্ট করে পায়ের কাছে বল করতে বললেন।
৫১ তম ওভারে এসে শোয়েব আখতার প্রথম বলটা পায়ের কাছেই করলেন, সাথে যোগ করলেন এক্সট্রা পেস। একের পর এক বল ফ্রন্টফুটে ডিফেন্স করা রাহুল দ্রাবিড় যেন বলটা বুঝতেই পারলেন না। অতি রক্ষণাত্বক ভঙ্গিতে ব্যাটিং করার ফল হাতেনাতে পেলেন তিনি। প্রথমেই পা সামনে দেওয়ার কারণে পা আর বলের ব্যবধানে স্পষ্ট দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। ফলে শোয়েব আক্তারের সে বলটি রিভার্স সুইং করে দুর্দান্ত এক ইয়র্কারে স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলে। রাহুল দ্রাবিড় রীতিমত সেই ডেলিভারিতে বিধ্বস্ত হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেন।
এরপরে উইকেটে আসেন শচীন টেন্ডুলকার। আর সেবারই প্রথম ক্রিকেট মাঠে মুখোমুখি হন শচীন টেন্ডুলকার-শোয়েব আখতার। সেখান থেকেই মূলত শুরু হয় শচীন টেন্ডুলকার- শোয়েব আখতার দ্বৈরথ। শচীনকে তাড়াতাড়ি আউট করা পাকিস্তানের জন্য খুবই দরকার ছিল। কারণ শচীন মাঠে দাঁড়িয়ে গেলে বড় লিডের সামনে দাঁড়াতে হতে পারে তাদের। অতীত অভিজ্ঞতা সেটাই বলে।
সেলিম মালিক শোয়েবকে পরের বলটি আউটসাইড অফ স্ট্যাম্প বরাবর করতে বললেন। আর বল কেমন সুইং করে তা দেখার জন্য আজহার মাহমুদ ফোর্থ স্টাম্প বরাবর বল করতে বললেন।
দুই সিনিয়র ক্রিকেটারের পরামর্শে পরের বলটি করতে বোলিং প্রান্তে যান শোয়েব আখতার। শোয়েব আখতারের ভাষ্যমতে, ‘আমি যখন পরের বলটি করার জন্য দৌঁড় শুরু করি তখন ওয়াসিম ভাইয়ের কন্ঠে শুনতে পাই, ‘ওকে আউট কর, নাহলে ও আমাদের পরের পাঁচ সেশন ফিল্ডিং করিয়ে ছাড়বে।’
তবে, মোক্ষম একটা বুদ্ধি আঁটলেন শোয়েব। তিনি বলেন, ‘এরপর বল ডেলিভারির সময় আমি যখন আমার হাত ছাড়ানো শুরু করি তখন দেখলাম, শচীন আমার ডেলিভারির আগেই ব্যাট তুলে ফেলেছে। তখনই ভাবলাম, ও আমাদের ফাঁদে পা দিয়েছে। এখন বলটা শুধু সামান্য শূন্যে ভাসিয়ে সুইং করাতে হবে। বলটা পরিকল্পনামাফিকই হয়েছিল। শচীন বলটা ড্রাইভ করতে যায়। কিন্তু বলটা ইনসুইং করে ভিতরে ঢুকে যায়। শচীন বোল্ড হয়।’
পরপর দুই বলে দ্রাবিড় আর শচীনকে ফেরানো শোয়েব আখতারের সেদিন উচ্ছ্বাসটা দেখার মতো ছিল। ঐ ইনিংসে শোয়েবের পাওয়া চার উইকেটের চারটিই ছিল বোল্ড আউট। রাহুল দ্রাবিড়ের আউটটাও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইয়র্কার দিয়ে দ্য গ্রেট ওয়ালকে বিপদে ফেলা কঠিন। অথচ, সেটাই সেদিন করেছিলেন শোয়েব আখতার।
৪৬ রানে জয় পাওয়া সে ম্যাচে শোয়েব আক্তার দুই ইনিংসে ৮ উইকেট পেলেও ম্যাচ সেরার পুরস্কার উঠেছিল সাঈদ আনোয়ারের হাতে। তবে সেরা পুরস্কারটা শোয়েব পেয়েছিলেন লাহোরে। সে সিরিজ শেষে তিনি যখন লাহোরে যান তখন লাহোরের জনতা তাকে কাঁধে উঠিয়ে বরণ করে নেয়। এটাই বা ম্যাচ সেরা পুরস্কারের চেয়ে কম কী?