হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া রঙ

একটা গল্প বলব আজকে। ক্রিকেটের গল্প, মানুষের গল্প, বাইশ গজে হওয়া ক্রিকেট-মানসের গল্প। চাইলে ধরে নিতে পারেন ক্রিকেটদেবীর কোন খেয়ালের গল্প। তবুও আমি গল্পটা বলব। কারণ গল্পটা আমাদের, গল্পটা ক্রিকেটের, গল্পটা ক্রিকেটারদের।

ক্রিকেট গ্লোবাল স্পোর্টস নয়। ফুটবল বিশ্বকাপের মত ক্রিকেট দামামা ছুঁয়ে যায়না এই বিশ্বের প্রতিটা মানুষকে। ক্রিকেট গ্যালারিও ফুটবল রাগবির মত মাতাল নয়, এশিয়া পেরিয়ে ওশেনিয়া, ইউরোপে ক্রিকেট গ্যালারিতে চা খেতে খেতে ব্যাটসম্যানের মারা চারের জন্যে হাততালি দেওয়ার দৃশ্যটাও আপনারা দেখতে পাবেন হরহামেশাই । তবুও এই ক্রিকেটের একটা গল্প আছে, আছে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া রঙ।

ক্রিকেটটা ছড়িয়ে দেওয়ার সময় বারবার একে বলা হয় – এটি শুধুমাত্রই একটি খেলা। আমরাও আমাদের ভেতরে কোথাও না কোথাও জানি এটি শুধুমাত্রই একটি খেলা। তবুও, ক্রিকেটটা শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্রই একটি খেলা হয়ে থাকেনি। থেকেছে ‘খেলার চাইতেও বিশেষ কিছু’ হয়ে। ক্রিকেট দিয়েছে জীবনের রঙ, নিয়েছে জীবনের রঙ, ‘খেলা ‘ ছাপিয়ে হয়ে গেছে ‘জীবন মেলা’। হয়ে গেছে বলাটা মনে হয় ভুল হল, আসলে ক্রিকেটে ঘটেছে এমন কিছু ঘটনা যা এটি হওয়াতে বাধ্য করেছে আমাদের।

এরকম একটি ঘটনা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০১৫ বিশ্বকাপে। এবি ডি ভিলিয়ার্স, নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? ঐ যে, যে ছেলেটা উইকেটের চারপাশে শটের ফোয়ারা ছুটিয়ে আমাদের আনন্দ দেয়। ছুটির দিনের দুপুরে, শীতের সকালে কম্বলের নিচে মোবাইল স্ক্রিনে যে ছেলেটার খেলা দেখে আমরা আমাদের ক্রিকেট ফ্যান্টাসির পুরোটা উপভোগ করি। ঐদিন ঐ ছেলেটা কেঁদেছিল।

এমনিতেই প্রোটিয়াদের বিশ্বকাপ ভাগ্য বড্ড খারাপ। একাদশে বড় বড় সব নাম নিয়েও কেন জানি আরাধ্য ট্রফিটা জয় হয়না ওদের। সেদিনও ঠিক তাই হয়েছিল। গ্রান্ট এলিওট যখন ব্যাট ঘুরিয়ে বল উড়িয়ে নিউজিল্যান্ডের জয় নিশ্চিত করলেন, স্বাগতিক গ্যালারি যখন ভেঙে পড়ছে উচ্ছ্বাসে, এবিডি ভিলিয়ার্স ভেঙে পড়লেন। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ঐ অর্থশূন্য চোখ ক্রিকেট ফ্যানাটিকদের মনে থাকবে অনেকদিন!

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলতেন, কেউ যদি বিশেষ কিছুর চূড়ায় উঠে যায়, ভারতবাসীর তাকে ভগমান না মানলে নাকি হয়না। ক্রিকেটে ভারতবাসীর এই ভগবানের নাম শচীন টেন্ডুলকার। দুই যুগ, ৩৪ হাজার ৩৫৭ আন্তর্জাতিক রান, একশোটা আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি- ব্যাট প্যাড তুলে রাখার আগে শচীন টেন্ডুলকার এমন সব কীর্তি গড়েছেন যা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব তা কখনও ভাবা যায়নি।

তবে, প্রেমও ধীরে ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, ক্রিকেট ঈশ্বরকেও বিদায় বলতে হয়। শচীন টেন্ডুলকারও একদিন বলে দিলেন, আমার হল সারা! ঠিক ঐদিন , গ্যালারি থেকে চায়ের টং, অফিস থেকে বেডরুম, ফ্লাট থেকে টিভি শোরুম, কে না কষ্ট পেয়েছে! ক্রিকেটের লিটল জিনিয়াস চলে যাবেন?!

ক্রিকেটের ঈশ্বর বলে দিয়েছেন বিদায়। তবে তাকে ঠিক ঈশ্বরের মনঃপুত বলা যাবেনা । কেননা, ঈশ্বরের পছন্দনীয় হলে তো তিনি তাকে ডেকে নিতেন নিজের কাছেই। ঠিক যেমন, ফিলিপ জোয়েল হিউজ! শন এবট যখন বাউন্সারটা ছুঁড়ে দিলেন, এমন কত বাউন্সার ফিল হিউজ জীবনে হুক খেলেছেন তার কি ইয়ত্তা আছে।

পারতেন সেদিনও! কিন্তু কি যে হল, হঠাৎ গিয়ে আঘাত হানল হেলমেটের ফাঁকে । সাথে সাথে মাটিতে পড়ে গেলেন হিউজ। আর তার কিছুদিন পর তো ক্রিকেটের সব মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন ওপারে। এই ঘটনা ক্রিকেট সমর্থকদের মনে থাকবে অনেকদিন। ক্রিকেট মিশিয়ে জীবনের রঙ কেড়ে নেওয়া এই ঘটনা কি আর চাইলেই ভোলা যায়?

ফিলিপ হিউজ চলে গেছেন, চলে যেতে পারতেন আরো একজন- যুবরাজ সিং। ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপে ছিলেন আস্থার প্রতীক, বল হাতে ছিলেন অধিনায়কের ব্রেক থ্রু এনে দেওয়ার আস্থা। ২০১১ বিশ্বকাপ জিততে যুবরাজ সিং এর চাইতে বড় সাহায্য কেউ করেছে কিনা তা নিয়ে তর্ক হতে পারে বেশ । সেই যুবরাজ সিংয়ের যখন ক্যান্সার ধরা পড়ল, ক্রিকেটটা যেন থমকে গেল।

ইয়োর্কারগুলোকে পেছনের পা সরিয়ে শিল্পীর তুলির মত করে গ্যালারি ছাড়া করেন যুবরাজ, সেই যুবরাজের ক্যান্সারে ভারতবাসী যেন ঐ উড়ে যাওয়া বলকে ক্যামেরায় ধারণ করলে যে স্থিরচিত্র ভেসে ওঠে, তেমন স্থির হয়ে গেল! তবে এই ঘটনা যদি আপনার ক্রিকেট জীবনের হতাশা বাড়িয়ে দেয়, যুবরাজের ক্যান্সার জয় করে ফিরে আসা সেই হতাশার গ্যাস বেলুনকে উড়িয়ে দিয়ে সেখানে প্রেরণা দিতে বাধ্য। একই ঘটনার কেমন উল্টো বয়ান- এটাই তো ক্রিকেট!

২০১১ বিশ্বকাপ নিয়ে বলছিলাম। এই বিশ্বকাপেই গ্যালারিতে ঘটে যায় তুমুল আলোচিত এক ঘটনা। চলছিল বিশ্বকাপ ফাইনাল। মহেন্দ্র সিং ধোনি হেলিকপ্টার শটে ক্রিকেটের সবচাইতে আইকনিক মুহুর্তটার জন্ম দেওয়ার ঠিক কিছুক্ষণ আগে, ওয়াংখেড়ের ৩০ হাজার ভারতীয় সমর্থক হঠাৎ গেয়ে উঠলেন, বন্দে মা তরম! কথাটার অর্থ করলে দাঁড়ায় মা কে বন্দনা করি। কিন্তু রুদ্ধশ্বাস ঐ ফাইনালে হঠাৎ করে এই যে গ্যালারির বন্দে মা তরম গেয়ে ওঠা, এখনও অবসরে ক্লিপ দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়। ক্রিকেটকে নিজের জীবনে ঠিক কতটা ধারণ করলে আকাশের পানে মুখ তুলে এভাবে গান গেয়ে ওঠা যায়!

আমি মাত্র কয়েকটা ঘটনা বললাম। ক্রিকেট নিয়ে এমন আবেগ, এমন দুরন্ত পাগলামির ঘটনা আছে আরো। যে ঘটনা প্রমাণ করে, ক্রিকেট শুধু একটি খেলা নয়!

 

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link