রানের বন্যা হোক এই শোক

দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার ডেভিড মিলারকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফলো করলে নিশ্চিতভাবেই আপনি অ্যানকে দেখে থাকবেন। ছোট্ট সদা হাস্যোজ্জ্বল অ্যানের ছবি আপনার মনে গেঁথে যেতে বাধ্য। মিলারের সাথে তাঁর খুনসুটি দেখে সবাই ভেবেছিল অ্যান বোধহয় মিলারেরই মেয়ে। কিন্তু ভুলটা ভাঙে, অ্যান মিলারের মেয়ে নন, সে মিলারের ক্ষুদে ভক্ত। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত মেয়েটা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পাড়ি জমিয়েছে পরপারের উদ্দেশ্যে। 

মিলার যে সময়ের ছবিগুলো পোস্ট করেছিলেন, তখনও ক্যান্সারের সাথে লড়ছিল শিশুটি। কিন্তু, ঠোঁটে কি দীপ্তিময় হাসি! কি দারুণ স্বপ্নবোনা চোখ দু’টো! কিন্তু, সবই আজ অতীত। ফ্রেমের ভেতরের ছবিটার চোখে আজ নেই কোনো রাগ কিংবা অভিমান।

২০১৭ সাল থেকেই ক্যান্সারের সাথে লড়ে যাচ্ছিলেন অ্যান। দীর্ঘ পাঁচ বছর লড়াইটা চালিয়ে গেলেও শেষে হেরেই গেলেন জীবনযুদ্ধে ক্যান্সার নামের এই মরনঘাতীর বিরুদ্ধে। তাঁর চিকিৎসার সমস্ত খরচ মিলারই চালাচ্ছিলেন। অ্যান মিলারের বন্ধুর মেয়ে হলেও তাঁকে ভালোবাসতেন নিজের মেয়ের মতোই।

মিলারের সাথে প্রায়ই ক্রিকেট মাঠে দেখা যেত তাঁকে। ভারত সফর আসার আগেও ক্ষুদে ভক্তের সাথে দেখা করে এসেছিলেন মিলার। কিন্তু দেশ থেকে দূর পরবাসেই তাঁকে জানতে হলো প্রিয় ভক্তের মৃত্যুসংবাদ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষুদে ভক্তের সাথে তোলা এক ভিডিওতে  ভালোবেসে দীর্ঘ এক আবেগঘন বার্তা লিখেন মিলার।

তিনি লিখেন, ‘আমি তোমার অভাব টের পাবো ছোট্ট স্কুট। আমার দেখা সবচেয়ে ভাল মনের মানুষ ছিলে তুমি। তুমি অসাধারণ এক পথ পাড়ি দিয়েছো। শত প্রতিবন্ধকতার মাঝেও কখনও হাসিটাকে হারিয়ে যেতে দাওনি। জীবনের প্রতিটা সমস্যা সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করেছো। তুমি আমাকে শিখিয়েছো কিভাবে জীবনের প্রতিটা মূহুর্তকে উপভোগ করতে হয়। তোমার সাথে একই পথে হাঁটতে পেরে আমি গর্বিত। আমি তোমাকে ভালোবাসি, শান্তিতে ঘুমোও।’

গত বছর দুয়েক ধরেই ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে আছেন মিলার। গুজরাট লায়ন্সকে আইপিএল এনে দিয়েছেন, বার্বাডোজ রয়্যালসকে সিপিএলের ফাইনালে তুলেছেন। ভারত সফরেও দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে খেলেছিলেন ৪৭ বলে ১০০ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস। একদিনের ম্যাচ শুরুর আগে তাই ফুরফুরে মেজাজেই ছিলেন এই হার্ড হিটার। 

কিন্ত এর মাঝেই দ্বিতীয় ওয়ানডের আগে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আসে অ্যানের মৃত্যুসংবাদ। কিন্তু মিলার তো যোদ্ধা, অ্যান তো তাঁকে ক্রিকেট মাঠে দেখতেই ভালোবাসতেন। শোকের পাথর বুকে নিয়ে কাল ম্যাচ খেলতেও নেমেছিলেন রাঁচিতে। চোখের প্রতিটা অশ্রুফোঁটা যেন ঝরছিল রান হয়ে।

আসলে যতই যোদ্ধা হন, নির্দয়ভাবে বলকে পেটান, সবকিছুর আগে মিলার তো একজন মানুষ। রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। মানবিক আবেগ-অনুভূতি তাকেও তো স্পর্শ করে। কাল রাঁচিতে তাই জীবনের সবচেয়ে লম্বা ম্যাচটাই খেলেছেন মিলার। 

মাঝে মাঝে ভাগ্যবিধাতা খুব বেশি নিষ্ঠুর আচরণ করেন। পৃথিবীকে কত কিছু দেবার ছিল ছোট্ট অ্যানের। ছোট্ট অ্যান স্বপ্ন দেখতো তাঁর আইডল বিশ্বকাপ জেতাবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে। হয়তো ভারত সফর শেষেই দেখা করে জানতে চাইতো উপমহাদেশের দেশটা কেমন লেগেছে আংকেল মিলারের। কিন্তু, বিধান মেনে নেয়া খুব কঠিন।

সবুজ বনানীতে ঘেরা পৃথিবীতে বিদায়ের করুণ বিউগল বাজিয়ে মৃত্যু যখন দুয়ারে এসে হাজির হয়, তখন আর ফিরিয়ে দেয়ার উপায় থাকে না। জীবনের এই দুঃসময়ে মিলারকে আরও পরিণত করে তুলবে। আশা থাকবে প্রিয়জন হারানোর বেদনা যেন তিনি দ্রুতই কাটিয়ে উঠতে পারেন। বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে মিলারকে দেখলে হয়তো ওপার থেকে সবচেয়ে বেশি খুশি হবে ক্ষুদে অ্যানই। ওপারে ভালো থেকো লিটল অ্যাঞ্জেল। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link