সুরিয়ার সূর্যোদয়ের পেছনের গল্প

সুরিয়াকুমার যাদবকে এক শব্দের বিশেষণে বিশেষায়িত করুন। ইরফান পাঠান বললেন, থ্রি সিক্সটি। আর গৌতম গম্ভীর বললেন, এক্স ফ্যাক্টর।

সম্প্রতি ভারতীয় এক চ্যানেলের টক শো’তে উপস্থাপকের করা সুরিয়াকুমার যাদব প্রসঙ্গে এমন মন্তব্যই করেছিলেন ভারতের সাবেক এ দুই ক্রিকেটার। আর তাদের বিশেষণের মিশেলেই যেন একজন পরিপূর্ণ সুরিয়াকুমার যাদব।

সুরিয়া মাঠের চারিদিকে অবলীলায় শট খেলতে পারেন। আবার মন্থর গতিতে এগিয়ে চলা দলীয় সংগ্রহকে হঠাৎ করেই শিখরে নিয়ে যেতে পারেন। তাই সুরিয়া যেমন এই মুহূর্তে ভারতের মিস্টার থ্রি সিক্সটি, ঠিক তেমনি এক্স ফ্যাক্টরও। 

আগের ম্যাচেই ফেরা যাক। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সুরিয়া কুমার যখন উইকেটে এলেন তখন ভারতের রান ১২ ওভারে ৮৪। আর এরপর উইকেটে সুরিয়ার আবির্ভাবের পরই ভারতের সেই রানটা ২০ ওভার শেষে গিয়ে ঠেকল ১৭৯ তে।

সুরিয়া নিজে খেললেন ২৫ বলে ৫১ রানের অপরাজিত একটি ইনিংস। টিপিক্যাল একটি দিন, সুরিয়ার  টিপিক্যাল একটি ইনিংস। এমন ঝড়ো ইনিংস খেলা যেখানে অন্য দেশের ক্রিকেটার বহুল আকাঙ্খার বিষয় সেখানে সুরিয়াকুমার যাদব এমন ইনিংসকে বলতে গেলে অভ্যাসই বানিয়ে ফেলেছেন। 

স্ট্রোক খেলার সময় বলের সাথে চোখে নিষ্পলক, নিখুঁত দৃষ্টি আর ঠিকঠাক ফুট ওয়ার্কের সাথে ব্যাটের টাইমিং, সুরিয়ার বিধ্বংসী ইনিংস খেলার ক্ষেত্রে রহস্য এটিই। তবে সেই রহস্য ভেদ করতে গিয়ে হিমশিম খাওয়ার মত অবস্থা বোলারদের।

ডাচ বোলার পল ভ্যান মেকেরেন সুরিয়াকে বল করার অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেছেন, শেষ ১২ মাসে বহু ব্যাটারকে বল করেছি। তবে সুরিয়ার মত কোনো ব্যাটারকে দেখিনি। ওকে বল করা খুবই রিস্কি। ওর ব্যাটিং স্ট্যান্স কিংবা শটের মুভমেন্ট কোনোটাই ভাল করে বুঝা যায় না। সুরিয়ার বিপক্ষে যখনই বল করতে গিয়েছি তখনই খুব চাপ অনুভব করেছি। ও রোহিত, কোহলির মতোই এখন ভারতের সেরা ব্যাটার।’ 

হঠাৎ করেই সুরিয়াকুমার যাদবের এমন বদলে যাওয়ার কারণ কী? মুম্বাইয়ের হয়ে শেষ কয়েকটা মৌসুম দুর্দান্ত ফর্মেই ছিলেন অবশ্য। তবে তিনি পরিচিত ছিলেন দারুণ সব ফ্লিক শটের কারণে। কিন্তু ভারতের দলে এসে যেন সুরিয়া ফ্লিকের পাশাপাশি স্ট্রেইট ড্রাইভে তুলে ছয়, কিংবা কভার প্রান্তে বড় শট, দুর্দান্ত রিফ্লেক্সে পুল শট মিলিয়ে সব ধরনের শটের পসরা সাজিয়েছেন। সুরিয়াকুমার যাদব অবশ্য নিজেই জানিয়েছেন এমন সাফল্যের পেছনের কাহিনী।

তিনি বলেন, ‘আমি যখন মুম্বাইতে মুম্বাইতে ফিরে আসি, তখন নিজের উপর কিছু চাপ প্রয়োগ করে প্র্যাক্টিস সেশনে যেতাম। আমি যে কয়টা বল অনুশীলন করি তা পূর্ণ মনযোগ দিয়ে করি। আর আমার টেকনিকটা হল, আমি ব্যাটিং প্র্যাক্টিসটাকেও ম্যাচের মত মনে করি। এমনকি ম্যাচের মতোই পরিস্থিতি মেনে চলি। যেমন ম্যাচে আউট হয়ে গেলে যেমন আমাকে প্যাভিলিয়নে ফিরে যেতে হয়, তেমনি প্র্যাক্টিস সেশনেও আউট হয়ে গেলে আমি অনুশীলন বন্ধ করে দিই। ঐ দিন আমি আর ব্যাট করি না। আর এই চাপটায় আমাকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসের জোগান দিয়েছে।’

ব্যাটিংয়ে চাপের মুহূর্তে কিভাবে এত সহজে ব্যাট করেন সুরিয়া কুমার যাদব। এমন প্রশ্ন অনেকেরই। সুরিয়া সেটিও খোলাসা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি যখন ব্যাটে যাই ম্যাচের পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, আমি খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। স্কোরবোর্ডে যদি পর্যাপ্ত রান থাকে আমি সেই গতিটা ধরে রাখার চেষ্টা করি। আর যদি রানের গতি কম থাকে তাহলে সেই গতি বাড়ানোর চেষ্টা করি। একদম সিম্পল। এতে হয়তো সব দিন সফলতা পাওয়া যায় না। তবে এমন মানসিকতা থাকা ক্রিকেটে খুব জরুরি। আমার মনে হয়, এটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে।’

সুরিয়াকুমার যাদব সাধারণ ভারতের ব্যাটিং অর্ডারে চারে খেলে থাকেন। টপ অর্ডার ব্যাটার, তারপরও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁর স্ট্রাইক রেট ১৭৭.৪৮! ২০২২ সালে ৭ ফিফটি আর ১ সেঞ্চুরিতে করেছেন ৮৬৭ রান। যা এ বছরের সর্বোচ্চ। এছাড়া, এই এক বছরেই মেরেছেন পঞ্চাশের বেশি ছক্কা।

রেকর্ড, ফর্ম, বিধ্বংসী ব্যাটিং- এখন পর্যন্ত সবকিছুর সুরিয়ার হয়ে কথা বলছে। এর মধ্য দিয়ে ক্যারিয়ারের সূর্যোদয়টাও করে ফেলেছেন তিনি। এখন শুধু সেই সূর্য যেন অস্তমিত না হয়, সেদিকেই লক্ষ্য রাখতে হবে তাকে। আপাতত রানের ফোয়ারায় ছুটতে থাকুক সুরিয়া কুমার যাদবের ব্যাট।   

 

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link