নামে কী বা আসে যায়!

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট শুরুর সময় থেকেই একটা ধারণা বেশ প্রচলিত আছে। ধারণাটি হল, টি-টোয়েন্টিতে ম্যাচ জেতাতে বড় নামের দরকার পড়ে। তাইতো ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের রমরমা এই দুনিয়াতে বড় বড় নামের প্রতি কাড়াকাড়ি পড়ে যায় দলগুলির। ভাবখানা এমন ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’ তবুও দলে বড় নাম চাই তাঁদের।

কিন্তু, এই টি-টোয়েন্টি এই আছে এমন সব ঘটনা, যা কিছুটা হলেও প্রমাণ করে টি-টোয়েন্টি মোটেও বড় নামের খেলা নয়। একটা দলের যদি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকে, সেই পরিকল্পনাটাকে যদি সেই দল মাঠে পুরোপুরিভাবে এক্সিকিউট করতে পারে, একটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ বা টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট জেতা কোন ব্যাপারই না।

টি-টোয়েন্টির শুরুটাই এই ঘটনা প্রমাণ করতে যথেষ্ট। বলছি, প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথা। ভারতীয় ক্রিকেট তখন টালমাতাল অবস্থায়। ওয়ানডে বিশ্বকাপের ভরাডুবির পর দেশে তখন চলছে ভারতীয় ক্রিকেটারদের প্রতি বিক্ষোভ। ঠিক এরকম একটা সময়ে আইসিসি আয়োজন করে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। শোনা যায়, এই বিশ্বকাপে ভারত অংশ নিতে চায়নি। না চাওয়ারই কথা। অধিনায়ক,কোচ সবাই হয়েছেন বরখাস্ত। ক্রিকেটাররা নিজ বাসাতেও থাকতে পারছেন না জনগণের তোপে। এমন অবস্থায় কিভাবে একটা টুর্নামেন্টে দল পাঠানো যায়?

এরপর নাকি আইসিসি ভারতীয় ক্রিকেটের সভাপতিকে চিঠি লিখে অনুরোধও জানিয়েছেন যাতে টুর্নামেন্টে ভারত অংশ নেয়। এই চিঠির কারণেই হোক বা অন্য যে কারণেই হোক, ভারত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশ নেয় । তবে সেই দলটাকে শুরুতেই ঠিক ‘হট ফেভারিট’ হিসেবে কেউ মানতে পারেনি। মানবেই বা কেন?

কোচ হিসেবে পাঠানো হয়েছে ‘লালচাঁদ রাজপুত’ কে। নতুন এক ছোঁকড়া ‘মহেন্দ্র সিং ধোনি’ কে করা হয়েছে অধিনায়ক। এমনকি, সেই দলটির দিকে তাকালে আপনি এই মুহুর্তে কিছু বড় নাম হয়তো খুঁজে পাবেন, কিন্তু সেই নামগুলি সেই সময় অন্তত বড় নাম ছিল না।

এই টুর্নামেন্টে ভারতীয় দলটির বিপরীতে অন্য সব দলেই ছিল হট ফেভারিট সব নাম। দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথ, এবিডি ভিলিয়ার্স, শন পোলক, মার্ক বাউচার, মাখায়া এনটিনি। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ম্যাথিউ হেইডেন, রিকি পন্টিং, মাইকেল হাসি, ব্রেট লি, অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস, কিংবা ধরুণ শ্রীলঙ্কার জয়াসুরিয়া, সাঙ্গাকারা, দিলশান, চামিন্দা ভাসের বিপরীতে ভারতীয় দলের কার্তিক, ইরফান পাঠান, আগারকারদের নামগুলি কি কোনভাবেই উচ্চারিত হয়?

আবার সেই টুর্নামেন্টে ভারত অংশ নেয় তখনকার ভারতীয় দলের স্তম্ভ সৌরভ, দ্রাবিড় এদের ছাড়াই।

তা নামের ভারে পিছিয়ে থাকলেও পরিকল্পনাতে মোটেও পিছিয়ে ছিল না ভারত। আর সীমিত সম্বলের এই সর্বোচ্চ ব্যাবহারে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে নেয় টিম ইন্ডিয়া।

‘বড় নাম’ই যে একমাত্র উপায় না সেটা দেখতে হলে আমাদের এবার ফিরে যেতে হবে আইপিএলের প্রথম আসরে।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশ নিতে না চাওয়া ভারত যখন প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে নিল, ভারতীয় বোর্ড কর্তারা বুঝতে পারলেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটই ক্রিকেটের লক্ষ্মী। তাই এটাকেই ব্যাবসার পুঁজি করতে পিছপা হলেন না, মাঠে নামিয়ে দিলেন ‘ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ’ বা আইপিএল। ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের সেই প্রথম আসরেই পড়ে গেল অর্থের ছড়াছড়ি। সব দেশের সব নামী ক্রিকেটারকে দলে টানার হিড়িক পড়ে গেল।

ব্যাঙ্গালুরু দলে টানল দ্রাবিড়, কোহলি, ক্যালিস, বাউচারকে। চেন্নাইয়ে তো স্বয়ং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতা ধোনীর সঙ্গে রাইনা, হাসি, হেইডেন, মুরালিধরণ। মুম্বাইয়ে পোলক, জয়াসুরিয়া, রঙকি, হরভজন। এভাবেই নানা দলে ছিল নানা বড় নাম।পরিসর বাঁচানোর জন্যে সেই নামগুলি লিখলাম না। আপনি চাইলে একটু ইন্টারনেট ঘেটেই তা জেনে নিতে পারেন। তবে এর মাঝে অন্যরকম এক দল গড়েছিল রাজস্থান রয়্যালস।

দলটাতে যে শেন ওয়ার্ন আর শেন ওয়াটসন ছাড়া কোন বড় নামই ছিল না। তবে মজার ব্যাপার হল, এই বড় নাম না থাকা নিয়েই সেবার চ্যাম্পিয়ন হয় রাজস্থান রয়্যালস। যেটি কিনা এখন পর্যন্ত রাজস্থানের একমাত্র আইপিএল ট্রফি। এই রাজস্থানের চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে চাইলে এখনকার আইপিএল দলগুলি একটা বার্তা কিন্তু নিতে পারে, কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে দল বানালেই হবেনা। দলটাতে প্লানিং আর ডেডিকেশন থাকতে হবে। এই ডেডিকেশনের জোরেই তো আইপিএল জিতে নিয়েছিল রাজস্থান, কোন বড় নাম ছাড়াই।

কিংবা ধরুন ২০১৫ এর বিপিএলটা। সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। কিন্তু আপনি যদি কুমিল্লা দলের দিকে তাকান, তাহলে সেখানে মাশরাফি বিন মুর্তজা ছাড়া কোন বড় নাম দেখবেন না। চাইলে মারলন স্যামুয়েলসের কথা বলতে পারেন,কিন্তু তিনি এতটাই অনিয়মিত ছিলেন যে ঠিক ভরসার যোগ্য ছিলেন না। ইমরুল কায়েস, লিটন দাস এরাও তখন এতটা ভরসার পাত্র ছিলেন না যতটা এখন আছেন। এই দল নিয়েই কুমিল্লা সেবার হয়েছিল চ্যাম্পিয়ন।

আপনি যদি সেই বিপিএলের বাকি দলগুলির দিকে তাকান, তাহলে কিছু বড় নাম আপনার চোখে পড়বে। অন্তত নামের ভারে অন্য দলগুলি তো কুমিল্লার চেয়ে এগিয়েই ছিল। ঢাকা ডাইনামাইটসের সাঙ্গাকারা, টেন ডেসকট, রংপুরের সিমন্স, সৌম্য, পেরেরা, সাকিব, স্যামি, চট্টগ্রামের তামিম, দিলশান, আমির, ট্রফি জয়ে অন্তত কুমিল্লাকে কেউ গোণায় ধরেনি শুরুতে।

অথচ সেই কুমিল্লায় হয়ে গেল চ্যাম্পিয়ন! এটা সম্ভব হয়েছিল কোচ সালাউদ্দিন আর ক্যাপ্টেন মাশরাফির জোড়া ক্যারিশমায়!

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এমন ‘নাম’ এর ভারে শক্ত দলগুলিকে হারিয়ে শুধু পরিকল্পনা আর সীমিত সামর্থ্যের সর্বোচ্চ প্রয়োগের উদাহরণ আছে আরও। ২০১২ সালের ঢাকা গ্লাডিয়েটরস, ২০১২ এর কোলকাতা নাইট রাইডার্স, নামের বিচারে ট্রফি জয়ের দৌড়ে ছিল না প্রথম থেকেই। অথচ এই দলগুলিই টুর্নামেন্ট শেষে পরে নিল জয়ের মুকুট।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল চাইলে এখান থেকে একটা বার্তা নিতে পারে। আমাদেরও তো টি-টোয়েন্টিতে সাকিব ছাড়া কোন বড় নাম নেই, নেই বিশ্বজুড়ে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলে বেড়ানো কোন নাম। আমাদেরও তাই কিছু একটা জিততে হলে দলের পরিকল্পনা আর ত্যাগের জোরেই জিততে হবে। হয়তো এটাই সেই তামিমের বলা ‘বাংলাদেশি ব্র্যান্ড অফ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট’।

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link