ক্রিকেটার-দর্শক রসায়ন

ভালো খেললে সাপোর্ট, খারাপ খেললেও সাপোর্ট - এটা জনপ্রিয়তার উন্নয়নে বিরাট চ্যালেঞ্জ। এটা তখন মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের মতো নিরঙ্কুশ আনুগত্য হয়ে যায়। দল যদি ভালো করে তাহলে যাদের জন্য ভালো করেছে তাদের প্রশংসা করতে হবে, খারাপ করলে যাদের জন্য খারাপ করেছে তাদের সমালোচনা করতে হবে। একজন দর্শকের এর বাইরে আসলে করারই বা কী থাকে!

স্যাম্পল হিসেবে ক্রিকেটার পেশাটিকে নির্বাচন করা হয়েছে, যেহেতু ভারতীয় উপমহাদেশে বিনোদনের যতগুলো মাধ্যম আছে জনপ্রিয়তায় ক্রিকেট শীর্ষতম। অস্ট্রেলিয়া স্পোর্টস লাভিং জাতি, ইংল্যান্ড ফুটবল-ক্রিকেট দুটো খেলারই আদি নিবাস, তবু ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা সেসব জায়গায় ভারত পর্যায়ের নয়।

বাংলাদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা এখনো যৌবনে পদার্পণ করেনি, বলা চলে টিনএজ দশায় আছে। বিশ্বকাপের মাত্র ৩য় আসরেই আন্ডারডগ হিসেবে আচমকা ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতের চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়াটা আইপিএল এর পূর্বে ক্রিকেট রাজনীতিতে অন্যতম শক্তিশালী ঘটনা। অবশ্য ভারতের ক্রিকেট ইতিহাস আরো অনেক পুরনো, এবং তা সংস্কৃতির অংশ।

বাংলাদেশে ক্রিকেট জনপ্রিয়তার প্রাথমিক ভিত্তি খুবই নড়বড়ে। আইসিসি ট্রফি জয় হেতু বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া, পাকিস্তানকে হারানো হয়তোবা সাময়িক উদ্দীপক হিসেবে চলতে পারে, কিন্তু তার পরম্পরা রক্ষার মতো কোনো উপকরণ ছিলো না।

ক্রিকেট কূটনীতিসূত্রে মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে পাওয়া টেস্ট স্ট্যাটাস এদেশের ক্রিকেট ভবিষ্যতকে সাময়িক নিশ্চয়তা দিলেও তা থেকে সুবিধা নেয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তখনো পর্যন্ত জনপ্রিয়তায় ফুটবল আর ক্রিকেটের যে ব্যবধান তা সহনীয় মাত্রায় ছিল, যার প্রমাণ হিসেবে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামকে ফুটবলের জন্য চিরতরে বরাদ্দ দেয়ার ঘটনাকে উল্লেখ করা যায়। ( যদিও জনপ্রিয়তার চাইতেও রাজনৈতিক রেষারেষি নীতিকে বড়ো করে দেখবো, তবু জনপ্রিয়তায় বিশাল ব্যবধান থাকলে সিদ্ধান্ত নেয়াটা কঠিন হতো৷ ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে মিরপুরের চাইতে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামকে এগিয়ে রাখবো বহুলাংশে)।

টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া ক্রিকেটের জন্য বড়ো ঘটনা হলেও জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে তার অবদান খুবই সামান্য। তবে আমার পর্যবেক্ষণানুসারে, জনপ্রিয়তার গ্রাফে বড়ো মোড় আনার ক্ষেত্রে টেস্ট ম্যাচের একটি ঘটনাই স্পার্কিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করেছে। অভিষেক টেস্টে আমিনুল ইসলাম বুলবুল সেঞ্চুরি করেছিলেন, সেটা ক্রিকেট জার্নালিস্ট আর নিখাদ ক্রিকেটমোদীদের বাইরে আলোড়ন তুলেনি তেমন। কিন্তু অভিষেকে আশরাফুলের সেঞ্চুরিটি গণমানুষকে উদ্বেলিত করেছিল, যতটা ক্রিকেটিয় কারণে তার চাইতে মাত্র সতেরো বছর বয়স এবং বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে রেকর্ড এই ফ্যাক্টটা ক্রিকেটের প্রতি নিরাসক্ত বহু মানুষকেও স্পর্শ করেছিল।

জাতি হিসেবে আমরা নিজেদের বঞ্চিত, শোষিত এবং নিপীড়িত ভাবতে পছন্দ করি। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে বেশিরভাগ মানুষই উত্তর দেয় – ‘এই তো আছি কোনোরকম’ – ফলে মিরাকল উপকরণ ব্যতীত কোনোকিছুতে মন ভরে না আমাদের। আশরাফুলের সেঞ্চুরিটা সেই ক্যাটেগরিভুক্ত হওয়ায় এটা জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে একটি অনন্য উপাদান।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই ম্যাচের পরে টানা ৫ বছর ওয়ানডেতে জয়হীন ছিল বাংলাদেশ। পাঁচ বছর পরে অচলাবস্থা কাটে যে জয়টাতে সেখানে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিল আশরাফুল। তবে এটা ক্রিকেটার আশরাফুলের এনডোর্সমেন্টে কাজে লাগলেও ক্রিকেট জনপ্রিয়তার রোডম্যাপে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নয়।

বাংলাদেশের পেস বোলিং নিয়ে কখনোই খুব আলোচনা হতো না। ধারণা করা হতো এদেশের পেসারদের গড়গতি ১৩০ এর বেশি হবে না। গত শতাব্দীর শেষভাগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এ দল ৪ দিনের ম্যাচ খেলতে ঢাকায় আসে। পেড্রো কলিন্স নামে এক বোলার ১৪২ কিলোমিটার/ঘণ্টা গতিতে বোলিং করে ব্যাটসম্যানদের নাজেহাল করে ছাড়ছে।

তার কিছু সময় আগে বা পরে (নিশ্চিত নই) বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব ১৭ দলের এক বোলার ১৭ বলে ৬৭ রান করে আলোচিত হয়। তার কিছুদিন পরে সেই বোলার বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে ভারত সফরে গিয়ে ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার গতি তুলেছে শোনা যেতে থাকে, যা বাংলাদেশের কোনো বোলারের জন্য রীতিমতো অবিশ্বাস্য। যেহেতু এদেশের মানুষ অসম্ভব বা মিরাকলে আগ্রহী, বাংলাদেশের কনটেক্সট এ এরকম বোলার দলে আসার আগেই তারকামুখ হয়ে উঠে। সেদিনের সেই বোলারটিই আজকের ১২০ কিলোমিটার গতির শেষ সময়ের মাশরাফি।

বাংলাদেশের ক্রিকেট জনপ্রিয়তার সূচনাবিন্দুতে আশরাফুল যদি হয় Y- অক্ষ, মাশরাফিকে X-অক্ষ মানতেই হবে; আশরাফুল যতোই ফিক্সিং করুক, কিংবা মাশরাফির ক্যারিয়ারের শেষটা যতোই বিদ্রুপাত্মক হোক।

৯০ এর দশকে সার্ক ক্রিকেট হতো মাঝেমধ্যে। সেখানে বাংলাদেশের মূল দল খেললেও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা পাঠাতো ‘এ’ দল। ২০০৪ সালে প্রথমবারের মতো ভারতকে হারায়। আমাদের শৈশবে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানে অন্যরকম উত্তেজনা ছিল। ৩০+ বয়স এবং শৈশবে ক্রিকেট অনুরাগী মাত্রই সেসময়ে ভারত কিংবা পাকিস্তানের সমর্থক ছিল। ফলে ভারতকে হারানো সেই সময়ের প্রেক্ষিতে অনেক বড়ো ঘটনা।

তবে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তায় এরচাইতেও গুরুত্ববাহী ১ বছর পরে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি। অস্ট্রেলিয়া বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, কোনো দলই পাত্তা পাচ্ছে না তাদের কাছে, উড়ে যাচ্ছে। সেই অবস্থায় পুঁচকে বাংলাদেশ হারিয়ে দিলো তাদের।

সেই ঘোর কাটতে না কাটতেই আশরাফুলের ৫২ বলে ৯৪ রানের ইনিংস! আমাদের বোলাররাই বরাবর বেধড়ক পিটুনি খেয়ে অভ্যস্ত, সেখানে আমাদের কোনো ব্যাটসম্যান এমন কাণ্ড ঘটাবে তা অকল্পনীয়ই ছিল। তার ২ বছর পরে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে মাশরাফির বোলিংয়ে ভারতকে হারিয়ে দেয়া বিশ্বকাপ রাজনীতিতেই বিরাট ঘটনা ছিল

তবে আশরাফুল অধারাবাহিক আর মাশরাফি ইনজুরিপ্রবণ হওয়াতে জনপ্রিয়তার ফোকাস পয়েন্ট পাওয়া যাচ্ছিল না।

কয়েক বছর পরে সাকিব অলরাউন্ডারের রেংকিংয়ে ১ নম্বর পজিশনে চলে আসে। আইসিসির রেংকিংয়ে কতজনই ১-২ এ থাকে, কিন্তু বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড় যেহেতু কখনোই ১ নম্বরে উঠতে পারেনি, এটার একিটা গ্রেটার সোস্যাল ভ্যালু তৈরি হয়, এবং সাকিব টানা অনেক বছর রেংকিংয়ের ১ এ থাকে, এক পর্যায়ে তার ট্যাগই হয়ে যায় বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। বাংলাদেশের ক্রিকেট জনপ্রিয়তার আতুড়ঘর পর্যায় পেরিয়ে হাঁটতে শেখার ক্ষেত্রে সাকিবের ১ নম্বর হওয়াটা প্রধান ঘটনা

তবে তখনো পর্যন্ত ক্রিকেট নিছক বিনোদনই ছিল। আমাদের সিনেমা থেকে রুচিশীল শ্রেণি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তরুণদের মধ্যে ব্যান্ডের ক্রেজ আছে, কিন্তু সেই ব্যান্ডও তো বৈশ্বিক পরিচিতি পায়নি, সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ দাপট দেখাচ্ছেন, কিন্তু স্বীকৃত বোদ্ধাগোষ্ঠী তাকে সমালোচনায় জর্জরিত করছে এবং বৈশ্বিক ইস্যুতে তিনিও স্থানিক; ফলে ক্রিকেট বিশ্ব যতই ছোট হোক সেখানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলছে এবং ১ জন ১ নম্বর পজিশনে আছে এটাই মূখ্য হয়ে উঠে।

সেই সময় পর্যন্তও ক্রিকেট এন্টারটেইনমেন্ট মিডিয়াম হিসেবেই ছিল। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশেই অন্তত ১টি টিম স্পোর্টস থাকে যা তাদের ন্যাশনালিজম স্পিরিটকে প্রমোট করে। স্পোর্টস বরাবরই তীব্র পলিটিক্যাল।

কোনো খেলাতেই সর্বোচ্চ পর্যায়ে সাফল্য না থাকায় বাংলাদেশে স্পোর্টস ন্যাশনালিজমের চাইতে এন্টারটেইনমেন্ট হিসেবেই চলছিল বেশ। ২০১২ এর এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ফাইনালে মাত্র ২ রানে হারের পর বাংলাদেশে ক্রিকেট এন্টারটেইনমেন্ট সত্তা হারিয়ে পলিটিক্যাল সত্তায় উত্তরিত হয়। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর সময়ও পলিটিক্যাল ইন্টিগ্রেশনের চেষ্টা চলেছিল, কিন্তু বাংলাদেশ তখন একেবারেই নবিশ থাকায়, সেই সাথে সমগ্র বাংলাদেশের ক্রিকেট সমাজ ভারত-পাকিস্তান দুই দলে বিভক্ত থাকায়, এবং সর্বোপরি ইউটিউব আর ফেসবুক অনাবিষ্কৃত থাকায় সেই চেষ্টার আউটপুট আসেনি।

২০১২ তে সিনারিও পুরোই আলাদা, যে কারণে ক্রিকেটের পলিটিক্যাল পারসপেক্টিভটাই মূখ্য হয়ে উঠে। ক্রমাণ্বয়ে ভারতের চাইতেও আমাদের এদিকে ক্রিকেট উন্মাদনা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

এই পর্যায়ে একটি এন্টিফোর্স তৈরি হয়, যারা ক্রিকেটের জনপ্রিয়তাকে মিনিংলেস এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে ক্রিকেটবিরোধীতা শুরু করে। দিন যাবে আর এন্টিফোর্স সক্রিয় হবে, মূলত তখনই ক্রিকেট যৌবনে পদার্পণ করবে।

মানুষের মতো ক্রিকেটেরও পারসোনালিটি ট্রেইট থাকে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ব্যক্তিত্ব এখনও অবিকশিত এবং কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ।

এর কারণ এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে রুচিবোধ গড়ে না উঠা এবং সংবেদনশীলতার ঘাটতিকে বিবেচনায় রাখা যেতে পারে।

তবে জনপ্রিয়তা আর সংবেদনশীলতা পরস্পর সাংঘর্ষিক। জনপ্রিয় হতে লাগে ভক্ত। ভক্তির মূল প্রতিপাদ্য নি:শর্ত সমর্পণ। যখনই আপনি কারো ভক্ত হয়ে পড়বেন, আপনি তার দ্বারা মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন, তার সবকিছুকে পছন্দ করতে চাইছেন, তার প্রতি অব্যক্ত এক অধিকার আর কর্তৃত্ববোধ তৈরি হয়েছে, তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি অনুভব করছেন অপরিমেয় বিদ্বেষ।

কেউ তার সমালোচনা করলে আপনার গা জ্বালা করে, মনে হয় সমালোচনাকারীর টুঁটি চেপে ধরি; পক্ষান্তরে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রশংসা শুনলে জিঘাংসা অনুভূতি জাগে৷ ফলে লারার খেলা আপনার যতোই ভালো লাগুক, কোনো কারণে টেন্ডুলকারের ভক্ত হলে নিজ থেকেই মনে হবে টেন্ডুলকারকে লারার চাইতে শ্রেষ্ঠ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। এবংং ফ্যান্ডম এক পর্যায়ে এতোটাই উগ্র হয়ে উঠে, তখন নিজ দলের খেলোয়াড়ের ফ্যানদের মধ্যেও বিবাদ বেঁধে যায়। সাকিব আর মাশরাফি একই দলে খেলছে, তবু একজনের ফ্যান আরেকজনকে সহ্য করতে পারবে না৷

ক্রিকেটকে যদি সিনেমার জায়গা থেকে দেখি আলোচনা বোধগম্য হওয়া সহজ হবে। আমরা যখন সিনেমার রিভিউ লিখি তখন বলি নায়কের অভিনয় ভালো হয়েছে, নায়িকার অভিনয় ভালো হয়নি, ক্যামেরার কাজ দুর্দান্ত হয়েছে, সংলাপগুলো জমেনি, স্টোরিটেলিং স্লো। – একটু খেয়াল করলেই বুঝবেন, প্রচণ্ড টেকনিকাল সব বিষয় যেগুলোতে আপনার সামান্যতম দক্ষতা নেই, প্রজ্ঞা নেই, সেসম্পর্কে অবলীলায় লিখে যাচ্ছেন, কারণ দর্শক হিসেবে আপনার সেই অধিকার আছে।

ব্রাড পিট যতোই অস্কার পাক, আপনার কাছ থেকে তার অভিনয়ের স্বীকৃতি পেতে হবে যদি পজিটিভ রিভিউ লিখতে হয়। কেউ আপনাকে বলবে না আগে নিজে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান, তারপর ফটরফটর কইরেন। আপনি যদি ডি ক্যাপ্রিও কে পছন্দ করে থাকেন, বড়োজোর তাকে নিয়ে নেগেটিভ মন্তব্য লিখতে পারে আপনাকে রাগানোর উদ্দেশে।

কিন্তু ক্রিকেট ম্যাচের রিভিউ লিখতে গিয়ে যদি বলেন তামিমের আউট হওয়াটা মানতে পারছি না বা মাশরাফির বোলিং একেবারেই নির্বিষ, ভক্তকুল বলবে কী-বোর্ডে লেখা খুবই সহজ, মাঠে যারা খেলে তারাই কেবল বুঝে কাজগুলো কঠিন, কিংবা আপনি নিজে মাঠে নেমে যান।

দুজনই ভক্ত- একজন নায়কের, আরেকজন ক্রিকেটারের, তাহলে আচরণের এই বিশাল বৈসাদৃশ্য কেন?

একজন ফিল্মস্টার প্রচণ্ড অসুস্থ্যতার মধ্যেও সিনেমার শুটিং করলে সেটা তার প্রফেশনাল দায়িত্ববোধ, কিন্তু ভাবুন তামিম ভাঙা হাত নিয়ে খেলছে, মুশফিক পাঁজরে ব্যথা নিয়ে খেলছে- এটা হয়ে যায় দেশপ্রেম। ক্রিকেটারের কাজ খেলা, সে না খেললে তার জায়গায় আরেকজন এসে পারফর্ম করে ফেললে দলে জায়গা হারিয়ে ফেলে কিনা সেই শংকার পাশাপাশি খেললে ম্যাচ ফি পাওয়ার ব্যাপারটা থাকে। এবং ক্রিকেট যে ধরনের খেলা পুরোপুরি ইনজুরিমুক্ত অবস্থায় খেলা একটি মিথ। কিন্তু মিডিয়া আর অন্যান্য ভক্তদের কল্যাণে আপনি তখন বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন ক্রিকেটার কত বড়ো দেশপ্রেমের পরিচয় দিচ্ছে।

এটা জনপ্রিয়তার পথে এক প্রকাণ্ড বাধা। আপনি তখন দলীয় ফলাফলের চাইতে সুনির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের আনুগত্য করবেন। খেলোয়াড় বাজে খেললেও অতীতের দোহাই দিয়ে তাকে একাদশে রাখতে চাইবেন, এবং যৌক্তিক সমালোচনাকে মনে হবে অকৃতজ্ঞতা।

ভালো খেললে সাপোর্ট, খারাপ খেললেও সাপোর্ট – এটা জনপ্রিয়তার উন্নয়নে বিরাট চ্যালেঞ্জ। এটা তখন মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের মতো নিরঙ্কুশ আনুগত্য হয়ে যায়। দল যদি ভালো করে তাহলে যাদের জন্য ভালো করেছে তাদের প্রশংসা করতে হবে, খারাপ করলে যাদের জন্য খারাপ করেছে তাদের সমালোচনা করতে হবে। একজন দর্শকের এর বাইরে আসলে করারই বা কী থাকে!

কিন্তু যেহেতু জনপ্রিয়তা আর সংবেদনশীলতা বিপরীত শর্তযুক্ত, যে কারণে শেষ পর্যন্ত ক্রিকেট পরাজিত হয়, ক্রিকেটারের স্বার্থসিদ্ধি ঘটে।

এই জায়গাতেই কর্তৃত্ব বনাম কতৃত্বহীনতা এবং জনপ্রিয়তা বনাম অজনপ্রিয়তার প্রসঙ্গটি গুরুতর হয়ে উঠে। একজন প্রশাসক জনপ্রিয়তা হতে চাওয়া মানে সে তার কর্তৃত্বপরায়নতার প্রতি আস্থাহীন। প্রশাসনের লক্ষ্যই থাকবে অজনপ্রিয় হওয়া,কারণ সঠিক এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের গুরুত্ব ভক্তকূলের বোঝার সাধ্য থাকে না, তারা কেবল গুরুর উপাসনা বা আরাধনায় ব্যস্ত থাকতে চায়। যেহেতু ভক্তের ধর্মই হলো ভক্তি, মার্কেটে নতুন যে ক্যারিশমাটিক প্লেয়ার আসবে সে তার ভক্ত হয়ে পড়বে; কোনো সুনির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের ভক্ত না হয়ে তার পক্ষে খেলা দেখা কঠিন। ফলে একদা যে হিরোর জন্য মন খারাপ করে ২ বেলা না খেয়ে থেকেছে, মার্কেটে নতুন হিরো এলে তার কথা মনেও থাকে না। টেন্ডুলকারের মূর্তি নাকি এককালে ভারতের ঘরে ঘরে থাকতো শোনা যায়; আজ সেই টেন্ডুলকার কোথায়?

ভক্ত সমালোচনা করবে, গালি দিবে, রক্ত দিয়ে চিঠি লিখবে – ইরেশনাল বিহেভিয়ার করবে বলেই সে ভক্ত, নইলে সে হতো বিশ্লেষক অথবা আলোচক। কিন্তু আমাদের প্রশাসন নিজেই জনপ্রিয়তা চায়, এবং ক্রিকেটারের ইচ্ছা-অনীহার কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে, যে কারণে কর্তব্য ভুলে ক্রমাগত মন জুগানো নীতির চর্চা করে।

ফলে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা অনেকটাই বিল্ডিংয়ে রডের বদলে বাঁশ দিয়ে কাজ চালানোর মতো অবস্থায় বিরাজ করছে। রডের কাজ যদি বাঁশ দিয়ে চলে যায়, চলুক তবে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...