হাসিমুখে তাঁরা লাফঝাঁপ দেয়। শরীরে থাকে শর্ট স্কার্ট আর টাইট টপস। চার পাশে দাঁড়িয়ে সেটা উপভোগ করেন দর্শক, কখনো কখনো কেউ ‘সিটি’ মেরে বসলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কিন্তু, এ তো বলিউডের কোনো সেট বা মুম্বাইয়ের কোনো আলো ঝলমলে নাইট ক্লাব নয়। এ তো রীতিমত ক্রিকেট, তাও এবার বিশ্বের এক নম্বর ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট – ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)।
এই টুর্নামেন্টটি যারা দেখেন, তাদের সবার নিশ্চয়ই এটুকু ধারণা আছে যে, এখানে আটটি দলেরই আলাদা আলাদা চিয়ারলিডারের দল আছে। আইপিএলের বিশাল সাফল্যের পিছনে এই চিয়ারলিডারদের অবদানের কথাটা একদমই অস্বীকার করা যায় না।
ঐতিহ্যগত ভাবে কোনো ব্যাটসম্যান যখন চার-ছক্কা হাঁকান তখন দর্শকরা তালি দিয়ে সেটাকে সাধুবাদ জানায়। কিন্তু আইপিএলে যখন কেউ বল গ্যালারিতে পাঠাবেন তখন গান বাজবে, কনসার্টের মত ধোঁয়া উঠবে, বাদ্যের তালে তালে চিয়ারলিডাররা নাচবেন।
এই নাচিয়েরা বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসেন। ব্রিটেন, ব্রাজিল, কানাডা, রাশিয়া দক্ষিণ আফ্রিকা – কোনো দেশই বাদ পড়ে না। এসব জায়গা থেকে এসে ভারতের তীব্র গরমে (৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের আশেপাশে) নাচাটা সহজ ব্যাপার নয়।
আইপিএলের প্রথম আসর, মানে সেই ২০০৮ সাল থেকেই এই ধারাবাহিকতা চলে এসেছে। যদিও, প্রথম আসরেই কিছু রাজনীতিবিদ এই চলটা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। তাদের দাবী ছিল, এরা নাকি একটু বেশিই খোলামেলা পোশাক পরে। কালের প্রবাহে এখন অবশ্য কিছু কিছু দলের চিয়ারলিডারদের পোশাক বেশ ভদ্রস্ত। নারী চিয়ারলিডারদের সাথে সাথে পুরুষদেরও দেখা যায়।
এখনও অবশ্য কিছু অভিযোগ শোনা যায়। টানা আট সপ্তাহ তারা ভারতে থাকেন। এই সময়ে খেলোয়াড়রা যেখানে অভিজাত হোটেলে থাকেন, বিজনেস ক্লাস বিমানের টিকেট পান, সেখানে চিয়ারলিডারদের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই দ্বিতীয় সারির হোটেল, ইকোনমি ক্লাসের বিমান টিকেট দেওয়া হয়।
যদিও, চিয়ারলিডাররা এসবকে ‘পার্ট অব জব’ বলেই মেনে নিয়েছে। দিল্লী ক্যাপিটালসের ১২ জনের চিয়ারলিডার দলের সদস্য ২৪ বছর বয়সী কেলি স্মিথ বলেন, ‘এখানে অনেক রকম নিয়ম কানুন আছে। সেসবের দিকে আমরা তাকাই না। আমাদের কাজ হল একটু ভিন্ন ভাবে দলের জয়ে ভূমিকা রাখা। প্রয়োজনে খেলোয়াড়দের সাথে দেখা করি, আলাপচারিতা চালাই।’
চিয়ারলিডারদের প্রায়ই নানারকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকে প্রায়ই নোংরা সব মন্তব্য আসে। স্যোশাল মিডিয়ায় তাঁদের নিয়ে ট্রল হয়। এই যেমন দিল্লীর চার্লি চ্যাপেলার কথাই ধরা যাক। কেউ একজন তাঁর একটা ছবি তুলে স্যোশাল মিডিয়ায় ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে বসেছে। দ্রুত ভারত ছাড়ার জন্য হুমকি-ধামকিও আছে।
উপমহাদেশের অনেক দেশের মত ভারতও নারীদের জন্য নিরাপদ নয়। ২০১৬ সালের হিসাব বলছে, প্রতিদিন ১০০ টি ধর্ষণের মামলা হয় ভারতে। তারপরও কেলি-চ্যাপেলিনারা আসেন। কারণ, তাঁরা আইপিএলকে ‘দারুণ একটা সুযোগ’ হিসেবে দেখেন।
চ্যাপেলিনা বলেন, ‘অনেকে অনেক রকম মন্তব্যই করে। খারাপ লাগে, তারপরই আবার ভাবি – এটা তো পৃথিবীর যেকোনো জায়গাতেই হতে পারে।’
আরেক চিয়ারলিডার কানাডার লিন্ডা লোপাটিস্কি বলেন, ভারতীয় পুরুষদের আচরণ তিনি গায়েই মাখেন না। বললেন, ‘আমি কেবল ভারতেই চিয়ারলিডিং করি। এখানকার মানুষ, সংস্কৃতি, পাগলামি আমি পছন্দ করি। যদি, ভারতীয় পুরুষদের আচরণের কথা বলি, তাহলে বলবো ওসব নিয়ে আমরা ভাবিই না। এটা শুধু আমারই ভাবনা, বাকিরা কি ভাবে আমি জানি না। আমরা কাজটা শতভাগ পেশাদারিত্বের সাথেই করি।’
চিয়ারলিডারদের কাজটা সহজ নয়। অনেকেই যখন শুরু করেন, তখন ক্রিকেট একদমই বুঝতেন না। কারণ, অধিকাংশই এমন দেশ থেকে আসেন যেখানে ক্রিকেটের নামও কেউ জানে না। এখন কাজের প্রয়োজনেই বুঝে ফেলেছেন। এমনই একজন হলেন ইংল্যান্ডের ববি ডোরিংটন। ক্রিকেটের আঁতুড়ঘরের মেয়ে হলেও তিনি আগে ক্রিকেট একদমই বুঝতেন না। এখন বোঝেন, শুধু বোঝেনই না এখন নতুনদের বুঝিয়েও দেন।
তিনি বলেন, ‘যারা আগে থেকেই আইপিএলে আছেন, তাঁদের জন্য ব্যাপারগুলো বোঝা সহজ। আমি নিজেও প্রথম ম্যাচ করার আগে কিছুই বুঝতাম না। এখন যেমন অন্যদের বলতে পারি কোনটা চার, কোনটা ছক্কা। দেখে দেখে আমরা সব শিখে ফেলেছি।’
চিয়ারলিডারদের ম্যাচপ্রতি আয় অবশ্য নেহায়েৎ কম নয়। তবে, ক্রিকেটারদের তুলনায় সেটা কিছুই না। ২০১৬ সালের হিসাব বলছে, ম্যাচপ্রতি চিয়ারলিডাররা ১৫০ থেকে ২০০ ডলার করে আয় করেন। আবার ম্যাচ জিতলে কেউ কেউ বোনাসও দেয়। চলতি হিসাবে টাকার অংকটা আরেকটু বেশিই হওয়ার কথা।
চিয়ারলিডার বাছাইয়ের প্রক্রিয়াটা শুনলে যে কেউই হয়তো চোখ কপালে তুলে ফেলবেন। অধিকাংশ চিয়ারলিডারই উচ্চশিক্ষিত। বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মহাদেশ ঘুরে চিয়ারলিডার বাছাই করেন। হাজার হাজার দর্শকদের সামনে ছোট পোশাক পরে লাস্যময়ী নাচের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই কড়া প্রশিক্ষণে অনেকেই বাদ পড়েন।
শুধু রুপ বা নাচের পারদর্শীতা নয়, এখানে ‘আই কিউ টেস্ট’ও নেওয়া হয়। এটা করা হয় কারণ, ক্রিকেটারদের সাথেও তাঁদের লম্বা সময় কাটানোর প্রয়োজন আসতে পারে। কখনো এমন কোনো খবর মিডিয়াতে আসেনি, তবে এটা অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’ যে প্রায়ই ক্রিকেটাররা চিয়ারলিডারদের সাথে গোপন সম্পর্কও গড়ে তোলেন।
তবে, ২০০৯ সালে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক এই ভারতীয় টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে চিয়ারলিডার স্কোয়াড গঠনের প্রক্রিয়া যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন ছিল। এর জন্য রীতিমত এক রিয়েলিটি শো’র আয়োজন করা হয়েছিল। নির্বাচক প্যানেলে ক্রিকেটার থেকে শুরু করে বলিউডি তারকারাও ছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে, আইপিএল আসলে ক্রিকেটের চেয়েও বিশাল এক ব্যাপার!