মুহুর্মুহু নাটক, আবেগ, ট্র্যাজেডি, হতাশা। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ বনাম ভারতের ম্যাচ যেন জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। অ্যাডিলেডে গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলায় বাংলাদেশের মন ভেঙে আরও একবার জয়ের হাসি হাসল ভারত।
বিগত কয়েকটি বৈশ্বিক আসরে ভারত – বাংলাদেশ ম্যাচে উত্তাপ ছড়িয়েছে ভীষণ রকম। ২০১৫ বিশ্বকাপের নো বল বিতর্কের পর এবারের ম্যাচেও ম্যাচের পর আলোচনা ছড়াচ্ছে ফেক ফিল্ডিং প্রসঙ্গ। একদম নিজেদের হাতের মুঠোয় থাকা ম্যাচ ফসকে যাবার পর বাংলাদেশি সমর্থকদের সব রাগ যেন গিয়ে পড়েছে বিরাট কোহলি এবং আম্পায়ারদের উপর। এ যেন সেই পুরনো গল্পের নতুন চিত্রায়ণ, নখ কামড়ানো ম্যাচ হেরে নিজেদের ভুল না খুঁজে জেতা উচিত ছিল, নিয়মের ভুল, প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়, আম্পায়ার কিংবা আবহাওয়ার উপর দোষ চাপিয়ে দেয়া।
ভারতের বিপক্ষে আরও একবার জয়ের খুব কাছে এসেও হেরে যাওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আম্পায়ারদের মুণ্ডপাত করছেন বাংলাদেশি সমর্থকরা। উল্টোটা হলে হয়তো কাজ করতেন ভারতীয় দর্শকরা।
দুই দলের ক্রিকেট সমর্থকদের বৈরিতার শুরু সেই ২০০৭ বিশ্বকাপ থেকেই। সেবার বাংলাদেশের কাছে হেরেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছিল ভারত। ক্যারিবিয়ান সাগর পাড়ে হওয়া সেই বিশ্বকাপে এক মাশরাফি বিন মর্তুজার সামনে উড়ে গিয়েছিল ভারতের বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইন আপ।
সেই থেকে শুরু। সিনিয়রদের মত দুই দলেত জুনিয়র ক্রিকেটারদের ম্যাচেও উত্তেজনার পারদ থাকে আকাশচুম্বী। পেসার রুবেল আহমেদ এবং বিরাট কোহলির মাঝে প্রথম লড়াইটা তো হয়েছিল জুনিয়র ক্রিকেটে থাকতেই।
২০১৫ বিশ্বকাপে ভারতের কাছে ১০৯ রানে হেরে যাওয়ার পর আম্পায়ারদের বাজে সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশে রীতিমত প্রতিবাদ মিছিল হয়েছিল। সেদিনের ম্যাচে রোহিত শর্মা আউট হলেও মার্জিনাল এক নো বল ডাকেন আম্পায়ার, পরে ব্যাটিংয়ে নেমে ফর্মে থাকা মাহমুদউল্লাহকেও ফিরতে হয় বিতর্কিত এক ক্যাচ আউটের শিকার হয়ে।
এরবাইরেও নানা সময়ে উত্তাপ ছড়িয়েছেন দুই দেশের ভক্ত-সমর্থকরা। মনে পড়ে, ২০১৫ বিশ্বকাপ শেষে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে মুস্তাফিজুর রহমানকে রান নেবার সময় ধাক্কা দিয়েছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। পরে সেই ধোনিকেই আউট করার পর মুস্তাফিজের হাতে ধোনির মুণ্ডকাটা ছবিতে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল পুরো ফেসবুক।
ক্রিকেটাররাও বাদ যান দর্শকদের এই উন্মদনা থেকে। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হেরে ভারত বিদায় নিলে মুশফিকুর রহিম খুশি হয়েছেন লিখে টুইট করেছিলেন। রবিচন্দ্রন অশ্বিন একবার ওমান-বাংলাদেশ ম্যাচের আগে ওমানের জয় কামনা করে পোস্ট দিয়েছিলেন।
পূর্বে ভারত-বাংলাদেশের বেশিরভাগ লড়াইতে ভারত এক তরফা জিতলেও গত কয়েক বছরে বদলে গিয়েছে দৃশ্যপট। বিশেষ করে আইসিসির বৈশ্বিক আসরে ভারতের জন্য বড় এক দুশ্চিন্তার নাম বাংলাদেশ। তবে এখনও ভারতকে ছুঁতে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে বাংলাদেশকে। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ যেখানে হারাচ্ছে পূর্বের আবেদন, সেখানে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ প্রতিবারই ছাড়িয়ে যাচ্ছে আগের ম্যাচের উত্তাপকে।
অ্যাডিলেডের ম্যাচটাতে জিতে গিয়েছে ভারত। বলা চলে, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাই জিতিয়ে দিয়েছেন ভারতকে। লিটন দাসের অমন দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের পর মিডল অর্ডারের ব্যাটসম্যানরা যেন আত্নহত্যার মিছিলে সামিল হয়েছেন। তবে বাংলাদেশ দেখিয়েছে বৈশ্বিক ক্রিকেটে অন্যতম বড় দল হওয়ার জন্য সঠিক পথেই রয়েছে তাঁরা।
মূলত পূর্বে এরকম বড় ম্যাচ না খেলার অভিজ্ঞতাই হারের যন্ত্রণায় ভাসিয়েছে বাংলাদেশকে। ম্যাচ শেষে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও স্বীকার করে নিয়েছেন সেটা। লিটনের রান আউটের পর বাকি ব্যাটসম্যানদের বাজে শট খেলে আউট হওয়া আবেগের বহি:প্রকাশ কিংবা অভিজ্ঞতার অভাবে কিনা জানতে চাইলে সাকিব বলেন, ‘আমার ধারণা দুটোই। ড্রেসিংরুমে সবাই শান্তই ছিল। যখন আপনার হাতে দশ উইকেট আছে এবং নয় ওভারে ৮৫ রান দরকার, আপনি সুযোগটা নিতে চাইবেন। তাছাড়া ওদের সেরা বোলার ভুবনেশ্বরের কোটাও ততক্ষণে শেষ। আপনি চ্যালেঞ্জটা নিয়ে ম্যাচটা জিততে চাইবেন।’
‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সেটা করতে পারিনি। এটা দুটো ঘটনারই সম্মিলন, কিছুটা অভিজ্ঞতার অভাব এবং আবেগ সামলাতে না পারা। তাছাড়া আমরা এরকম উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ খুব বেশি খেলার সুযোগ পাই না।’, বলেন সাকিব।
আবেগে ভেসে না গিয়ে বরং পেশাদারিত্বের সাথেই ম্যাচ পরবর্তী সম্মেলনে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তর দেন সাকিব। তবুও ম্যাচের শেষে ফেক থ্রো, ডিএলএস মেথড কিংবা মাঠ ভেজা ছিল কিনা এসব বিতর্ক যেন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।