ভারতের ব্যর্থতার নেপথ্যে টপ অর্ডার

যত গর্জে তত বর্ষে না, বলে বাংলায় একটা প্রচলিত প্রবাদ আছে। ক্রিকেট বিশ্বে এই প্রবাদটা ভারতের ক্ষেত্রে এখন বেশ যুতসই। প্রায় এক দশক ধরে আইসিসির যেকোনো টুর্নামেন্টেই চিরায়ত ফেবারিট দল ভারত। কিন্তু এই এক দশকের মাঝে শুধু ‘ফেবারিট’ তকমার মাঝেই আটকে আছে টিম ইন্ডিয়া। 

২০১৩ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পর দুটি করে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হয়েছে, একটি আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আর একটি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপ হয়েছে। কিন্তু ৯ বছর আগে পাওয়া আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শিরোপা জেতার পর আর একটিও শিরোপা জেতেনি ভারত। মহেন্দ্র সিং ধোনির পর নেতৃত্বের ব্যাটন বদলে বিরাট কোহলি, এরপর রোহিত শর্মার কাছে গিয়েছে। কিন্তু, ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম এই জায়ান্ট দলটা একটা লম্বা সময় ধরে আছে শিরোপা শূন্য। 

এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার উদ্দেশ্যের অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিল ভারত। নতুন অধিনায়ক রোহিত শর্মার হাত ধরে দিন বদলের অপেক্ষায় ছিল শত কোটি সমর্থক। কিন্তু দিনশেষে সেটা হয়নি। সেমিফাইনালেই আটকে গিয়েছে সেসব স্বপ্ন। আর ভারতের এমন ব্যর্থ যাত্রায় আঙুল উঠছে স্বয়ং রোহিত শর্মার দিকেই। বিশ্বকাপ জুড়ে ছিলেন সুপার ফ্লপ।

আর তাঁর ব্যক্তিগত ব্যর্থতায় প্রতি ম্যাচেই ভারতের শুরুটা হয়েছে বেশ সাদামাটা। তাঁর আর রাহুলের জুটিতে মন্থর গতির শুরুর প্রভাব পড়েছে দলেও। সুরিয়াকুমার যাদব, বিরাট কোহলি সেই চাপ কাটানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আড়ালে যায় নি রোহিত-রাহুলের এমন ধীর গতিতে ইনিংস শুরুর ব্যাপারটি। বিশ্বকাপের ব্যর্থ মিশন শেষে ময়নাতদন্তে বেরিয়ে এসেছে পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে চলা ওপেনিং জুটির এ দৈন্যদশা। 

ক্রিকভিজের এক তথ্যানুসারে, এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর সবচেয়ে কম সবচেয়ে ধীরগতিতে পাওয়ার প্লে শেষ করেছে ভারত। এ সময়ে তাদের রান রেট ছিল ৬.০২। আরও একটি তথ্য অবশ্য বেশ ভাবনার খোরাক যোগায়। ২০১১ বিশ্বকাপে শচীন আর শেবাগের সম্মিলিত স্ট্রাইক রেট এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের ওপেনিং জুটি রোহিত রাহুলের চেয়েও বেশি ছিল!  

এমন একটা তথ্যে অবাক হওয়ার কারণ হল, এই দুই বিশ্বকাপের ফারাকটা বিস্তর। ২০১১ বিশ্বকাপটা ছিল ওয়ানডে ফরম্যাটের। আর এগারো বছর পরের এ বিশ্বকাপটা টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের। স্বাভাবিক ভাবেই টি-টোয়েন্টিতে ব্যাটিং স্ট্রাইক রেট বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু রোহিত-রাহুল জুটির এবারের ব্যাটিংটা এতটাই বিবর্ণ ছিল যে, সময়ের ব্যবধানের ১১ বছর আগের সেই ওয়ানডে বিশ্বকাপের ওপেনিং জুটিকে তারা টপকাতে পারেনি।  

রোহিত-রাহুল জুটির এমন করুণ দশার কারণ কী? ২০২১ থেকে শুরু করে এই বিশ্বকাপের আগ পর্যন্তও ভারতের ওপেনিং জুটি থেকে পাওয়ার প্লে তে সর্বোচ্চ রান এসেছে। তাহলে হঠাৎ এমন ছন্দপতনের কারণ? কারণ হিসেবে সামনে আনা যায় দুটি ফ্যাক্টর। প্রথমটি হল কন্ডিশন। কন্ডিশনের দায় দিয়ে যদিও পার পাওয়া যায় না।

তারপরও অস্ট্রেলিয়ার কন্ডিশন উপমহাদেশের চেয়ে পুরোপুরিই আলাদা। এখানে পেসাররা দারুণ সুবিধা পায়। আর যদি সময়টা হয় মধ্য নভেম্বর তাহলে ফাস্ট পিচ আর ভারী আউটফিল্ডের কারণে ব্যাটারদের রান করতে বেশ বেগ পোহাতে হয়। সেক্ষেত্রে পেসাররা আরও বেশি সুবিধা পায়।

কন্ডিশনের ভিতরেই আরেকটি বিষয় হল, এখানকার আবহাওয়া। এমন শীতল আবহাওয়া, একই সাথে বৃষ্টির সাথে খুব একটা পরিচিত নয় উপমহাদেশের ক্রিকেটাররা। তাই এমন প্রতিকূলতায় নিজেদের সেরাটা দেওয়াটাও বেশ কঠিন হয়ে যায়। যদিও আবহাওয়াকে দায় দেওয়াটা শেষ পর্যন্ত ধোপে টিকে না। কারণ ভারত এর আগেও অস্ট্রেলিয়া সফরে এসেছে। অস্ট্রেলিয়া সফরে এসে তারা রীতিমত সিরিজও জিতেছে। তাই নির্দিষ্ট করে একটা টুর্নামেন্টের ব্যর্থতার দায় বৃষ্টিকে দেওয়া যায় না। 

এখন প্রশ্ন হল, ভারতের না হয় ওপেনিংয়ে বাজে শুরু হয়েছে। কিন্তু অন্য বড় দলগুলো ঠিকই তো কোনো না কোনো ম্যাচে দারুণ গতিতে রান করেছে। এক্ষেত্রে ফ্যাক্টর হতে পারে রোহিতের অফ ফর্ম। বেশ কিছুদিন ধরেই ধারাবাহিকভাবে খেলতে পারছেন না তিনি। আর লোকেশ রাহুল আইপিএল থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, কোনো জায়গাতেই ওভার দ্য টপ খেলেন না। আর এমন সমন্বয়হীনতার কারণেই এ জুটি থেকে এবার ভাল শুরু আসেনি। বাজে শুরুর প্রভাবটা দিনশেষে দলের উপরেও পড়েছে প্রবলভাবে।  

খুব অবাক শোনালেও, এমন ব্যর্থতার পেছনে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটেরও দায় আছে কিছুটা। আইপিএল একটা ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক বৈশ্বিক ক্রিকেটারদের টুর্নামেন্ট। কিন্তু ঘরোয়া টুর্নামেন্ট বলতে যেখানে শুধু লোকাল ক্রিকেটাররাই খেলবে এমন টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট আছে একটি, সৈয়দ মুশতাক আলী টি-টোয়েন্টি ট্রফি। রাজ্য হিসেবে আরও কিছু আছে। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে বিসিসিআই এই একটি টুর্নামেন্টই আয়োজন করে। 

সমস্যা হচ্ছে, এই টুর্নামেন্টের মাঠ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে কোনো ব্যবস্থায় খুব একটা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলে না। সেই মান্ধাতার আমলের মতই এ টুর্নামেন্টে রান হয় ধীর গতিতে। কারণ উইকেট নিয়ে বিশেষভাবে কোনো কাজই করা হয় না। অথচ, ইংল্যান্ডের অবকাঠামোর দিকে তাকালেই অন্য একটা চিত্র পাওয়া যায়।

সাদা বলের ক্রিকেটের জন্য তাদের পিচ থাকে পুরো ব্যাটিং সহায়ক। উদ্দেশ্য একটাই, ব্যাটারদের হিটিং এবিলিটি আরও শক্তপোক্ত হওয়া। ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের এই ভাবনা যে রাতারাতি কাজে দিয়েছে তা নয়। কিন্তু তারা এই ভাবনার মাঝে আত্মবিশ্বাসী ছিল। ইংল্যান্ড এখন সুফল পাচ্ছেও বেশ। সন্দেহাতীত ভাবে সাদা বলের ক্রিকেটে ইংল্যান্ড এই মুহূর্তে অন্যতম সেরা একটা দল। 

কিউই গ্রেট স্টিফেন ফ্লেমিং একবার বলেছিলেন, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৬৫ বলে ১০০ এর চেয়ে ৪০ বলে ৭৫ এর কার্যকারিতা বেশি। ভারতের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, টপ অর্ডারের পুরো লাইন আপ নামে বেশ বড়। কিন্তু এ সময়ে এসে টপ অর্ডারে অন্তত একজন বিগ হিটার প্রয়োজন। যে মুহূর্তের মাঝেই প্রতিপক্ষ বোলারদের ছিটকে দিতে পারে। ভারতের টপ অর্ডারে সেটিরই অনুপস্থিতি আছে।

ইংল্যান্ডের মত পরিকল্পনামাফিক নতুন করে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়ায় ভারত হয়তো সহসায় সাফল্য পাবে না। কিন্তু একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকলে এর সঠিক একটা ফল আসবেই। আর সামনের ক্রিকেট বিশ্ব হবে টি-টোয়েন্টি নির্ভর। এর মাঝে মুহুর্মুহু সময়ে পাল্টাবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সংজ্ঞা। এর মধ্যে টিকে থাকতে হলে ভারতকেও আলাদা চিন্তা করে চলতে হবে। সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নয়তো, ফেবারিটের তকমা থাকলেও দিনশেষে ফিরতে হবে শূন্য হস্তে।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link