নেইমার, অভিনেতা তবুও মধ্যমণি

সালটা ২০১৪, ব্রাজিলের ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ। হেক্সা জয়ের স্বপ্নে বুদ গোটা সেলেসাও সমর্থক গোষ্ঠী। ব্রাজিলের খেলোয়াড়রাও নিজেরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন নেইমারকে কেন্দ্র করে। কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার মুখোমুখি ব্রাজিল। ম্যাচটা সেবার জিতেই নিচ্ছে ব্রাজিল। সেমিফাইনালের পথটা একদম পরিস্কার। খানিক বাদেই হবে আনন্দ উল্লাস। তবে না, সেবার আর আনন্দ উল্লাস হয়নি। বিষাদের এক মস্ত বড় আকাশ ভেঙে পড়ে পুরো ব্রাজিলের উপর।

কলম্বিয়ান খেলোয়াড়ের করা এক অপ্রয়োজনীয় ট্যাকেল। নেইমার মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। সবাই হয়ত ভেবে বসলেন, নিশ্চয় তা অভিনয়। তবে নেইমারকে সেবার মাঠ ছাড়তে হয়েছিল স্ট্রেচারে করে। এরপর জানা গেল আর খানিকটা এদিক ওদিক হলেই নেইমার বাকি জীবনটা কাঁটাতে হতো হুইলচেয়ারে করে। এরপর যেন গোটা ব্রাজিল মুষড়ে পড়ে। তাঁর ফলাফল নিশ্চয়ই সবার জানা।

সেখান থেকেও নেইমার ফিরে এসেছেন। ফিরে এসে নিজের ছোট্টবেলায় দেখা স্বপ্নটা আরও একবার পূরণের আশায় বুদ হয়ে আছেন নেইমার। এবারের কাতার বিশ্বকাপে আরও একবার তাঁকে কেন্দ্র করেই সাজানো হচ্ছে ব্রাজিলের সকল পরিকল্পনা। তিনি এবারও থাকছেন দলটির মধ্যমণি হয়ে। সম্ভবত এটাই নেইমারের শেষ সুযোগ। তিনি নিজে সেটা খুব ভাল করেই আন্দাজ করতে পারেন। তাইতো নিজের সর্বোচ্চটুকু উজাড় করে দিতে বদ্ধপরিকর। সে সব নিয়েই তিনি আলাপ করেছেন ইংল্যান্ডের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফের সাথে।

বিশ্বকাপ জেতাই নেইমারের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বকাপ জয় করাই আমার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। যখন থেকে ফুটবল বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই এটা আমার স্বপ্ন। আমি আরও একটি সুযোগ পাচ্ছি। আমি আশা করি আমি এবার জিততে পারব।’ তিনি হয়ত প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। তবে ব্রাজিলের ২১ কোটি মানুষই যেন নেইমারের স্বপ্নকে নিজের স্বপ্নে পরিণত করেছেন। তাঁরা চান ব্রাজিলিয়ান এই পোস্টারবয়ের হাতের স্বর্ণালী সেই ট্রফিটি দেখতে।

দুই দশকের অপেক্ষা অবসান অন্তত এবার দেখতে চান ব্রাজিলিয়ানরা। তেমন প্রত্যাশা নিশ্চয়ই বিশ্বজুড়ে থাকা ব্রাজিল সমর্থকদের। ল্যাটিন ফুটবলের ধারক হয়ে এখনও তো নান্দনিকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে তাঁরা। সেখানে নেইমারের অবদানটাও অগ্রাহ্য করবার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। আর মাত্র দুইটি গোল করতে পারলেই তো তিনি ছাড়িয়ে যাবেন ফুটবলের রাজা খ্যাত স্বদেশী পেলেকে। দুইটি গোল কাতার বিশ্বকাপের মঞ্চেই হয়ত করতে চাইবেন নেইমার। তবে অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকতে তিনি চান না। লক্ষ্যটা সবসময়ই থাকে সুবিশাল।

তিনি চান অন্তত পাঁচটি গোল করতে এবারে বিশ্বকাপে। হাস্যরসে বলা কথাটা নেইমার যে চাইলেই সত্যি করে ফেলতে পারেন সেটা নিয়ে কারও হয়ত সন্দেহ নেই। তবে তাঁকে রুখে দেওয়ার মত দলের নিশ্চয়ই অভাব নেই। তবে অতশত চিন্তায় এখনই নিজেকে ডুবিয়ে ফেলতে চান না, ‘সবারই অনেক আশা থাকে বিশ্বকাপকে ঘিরে। সবাইকে দুশ্চিন্তা না উদ্দীপনা ছুঁয়ে যায়। সবাই বিশ্বকাপে উপস্থিত হতে চায়।’ নেইমারের বলা এই কথা গুলো নিশ্চয়ই আরও একটিবার মনে করিয়ে দেয় যে তিনি কতটা উন্মুখ হয়ে রয়েছেন কাতার বিশ্বকাপকে ঘিরে।

তাঁর মত বিশ্বব্যাপী পাগলাটে ফুটবল সমর্থকরা। গোটা দুনিয়া আরও একটাবার মেতে উঠবে দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থের উন্মাদনায়। নিশ্চয়ই বিশ্বকাপের আগে খেলোয়াড়দের মধ্যেও এই নিয়ে হয়েছে আলোচনা। বছর চারেক বাদে আবার বিশ্বকাপের আসর বসছে। তা নিয়ে আলাপ নিশ্চয়ই হবার কথা। বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা তিন খেলোয়াড় নেইমার, লিওনেল মেসি ও কিলিয়ান এমবাপ্পে ক্লাব পর্যায়ে খেলেন একই দলে। তবে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তাঁরা একে অপরের প্রতিপক্ষ।

সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের মধ্যে অন্তত দুই দল কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছাবে। তবে নেইমার চান ফাইনালটা খেলা হোক ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার মাঝে। তিনি মেসিকে কথাও দিয়ে এসেছেন ফাইনালে তাঁকে হারাবার। মজার ছলেই বলেছেন নেইমার। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি তাঁকে (মেসি) বলে এসেছি যে আমি চ্যাম্পিয়ন হবে তাঁর বিপক্ষে খেলে। এরপর আমরা খুব হেসেছি।’ হ্যাঁ, মেসি-নেইমারের বন্ধুত্ব নিয়ে অবশ্য নতুন করে বলবার কিছু নেই।

বার্সেলোনায় থাকাকালীন তাদের বন্ধুত্বের সূত্রপাত। সেটা যেন প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ে এসে সেই বন্ধুত্বের বন্ধন আরও জমাট বেধেছে। তবে ২০১৪ সালে বন্ধু নেইমার ফাইনাল অবধি পৌঁছাতে না পারলেও মেসি পেরেছিলেন। সেই বিশ্বকাপটা জেতা হয়নি মেসির। আর নেইমারের চোট তাঁকে এবং তাঁর দলকে ছিটকে দেয় ফাইনালের দৌড় থেকে। সেবারে বিশ্বকাপটা নেইমারের জন্যে খুবই স্পেশাল ছিল। তেমনটাই অভিমত ব্যক্ত করেছেন নেইমার।

তিনি বলেন, ‘যতগুলো বিশ্বকাপ আমি খেলেছি সবগুলোই আমার কাছে স্পেশাল। তবে ২০১৪ সালের বিশ্বকাপটা একটু বেশি। কারণ সেটা ব্রাজিল আয়োজন করেছিল এবং সেটা আমার প্রথম বিশ্বকাপ ছিল। আশা করছি এটাও স্পেশাল হবে।’ এবারের বিশ্বকাপ নেইমারের শেষ বিশ্বকাপ হতে চলেছে। সেটা নেইমার বিশ্বাস করেন। অন্তত তাঁর সাম্প্রতিক মন্তব্য সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়।

বয়স যে খুব বেশি হয়েছে নেইমারের, বিষয়টা তেমন নয়। তবে ইনজুরি জর্জরিত ক্যারিয়ারটা খুব বেশি লম্বা হয়ত করতে চাইবেন না নেইমার। চাইলেও হয়ত পারবেন কি না সে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাইতো তিনি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েই এদফা শেষ চেষ্টাটা করবেন। পথটা বন্ধুর, সেটা তিনিও মানেন। বিশ্বকাপ এক উত্তেজনার অগ্নিকুণ্ড সেটা বিশ্ব ফুটবলের তারকা ফুটবলার নেইমার বিশ্বাস করেন। এবারের বিশ্বকাপকে ঘিরে তিনি নিজের প্রত্যাশার কথাও উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেন, ‘ফুটবল বিশ্বকাপ চমকে ঠাসা। অপ্রত্যাশিত ও অবিশ্বাস্যভাবে অনেক দল এই টুর্নামেন্টের বহুদূর অবধি চলে যায়। তবে আমি মনে করি আর্জেন্টিনা, জার্মানি, স্পেন ও ফ্রান্স এই চার দল সেই সাথে ব্রাজিল ফাইনালের যাবার মত সক্ষমতা রাখে।’ তিনি এটাও স্মরণ করে দিয়েছেন যে ইংল্যান্ডেরও বেশ সম্ভাবনা রয়েছে এবারের বিশ্বকাপে।

এতসব ভাবনার মাঝে নেইমার নিজের অবস্থান ও দলকে নিয়েই বেশি চিন্তা করছেন। এবারের মৌসুমে দারুণ ছন্দে রয়েছেন তিনি। প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ের হয়ে দারুণ একটা মৌসুম কাটাচ্ছেন। গোল তৈরি করে দিচ্ছেন সতীর্থদের। আবার সময় সুযোগ বুঝে নিজেও বল জালে জড়াচ্ছেন। তাই ব্রাজিলের সমর্থকরা খানিকটা আশাবাদি হতেই পারে। একজন ইনজুরিমুক্ত নেইমারই তো ২০১৪ ও ২০১৮ বিশ্বকাপে বহুদূর অবধি টেনে নিয়ে গেছেন ব্রাজিল দলকে।

২০১৪ তে কলম্বিয়ার বিপক্ষে সেই আঘাত ও ২০১৮ সালে চীনের প্রাচীর বনে যাওয় থিবো কোর্তোয়া নেইমারের বিশ্বকাপ জয়ের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এবারও সেই স্বপ্ন জয়ের বাঁধার কমতি থাকবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু নেইমার খানিকটা নির্ভার হয়েই খেলতে পারবেন এবারের আসরটা। তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে একঝাঁক তারকা খেলোয়াড় রয়েছেন আক্রমণভাবে। নির্ভার নেইমার যেকোন প্রতিপক্ষকে স্রেফ উড়িয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রাখেন সেটা তো সবারই জানা।

আরও একবার সাম্বা ছন্দে পুরো বিশ্বকে নাচাতে পারবেন কি না নেইমার, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে নেইমার এবং তাঁর সতীর্থরা হেক্সা জয়ের মিশন নিয়ে বুদ। তাঁরা একটা ফোঁটা ছাড় দেবেন না, এটা বলে দেওয়াই যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link