পিনোশের শাসন, বিশ্বকাপের রাজনৈতিক প্রহসন

ফিফার ইতিহাস ঘাঁটলে প্রচুর কলঙ্কজনক ইতিহাস পাওয়া যাবে। ঘুষ, দুর্নীতি তো বটেই, স্বৈরশাসকদের সাথে তাদের মাখামাখির ইতিহাসও কম নেই। যেমন ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপ, ১৯৭৮ সালের আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ, ১৯৩৪ সালের ইতালি বিশ্বকাপ।

অবশ্য, মানবতা বিরোধী ও যুদ্ধবাজদের কথা আমলে আনলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ অনেক দেশের নামই আসবে। তবে, এ কথাও সত্য যে এসব দেশে সরাসরি তখন কোন স্বৈরশাসন চলছিল না।

যাই হোক, বলতে গেলে অনেক কথাই চলে আসবে। তার চেয়ে বরং আজ চিলির কুখ্যাত স্বৈরশাসক পিনোশে’র আমলের ফুটবলের কথা জানা যাক।
১৯৭৩ সালে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের খেলার প্লে অফ ম্যাচ পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চিলি’র মধ্যে। মস্কোতে অনুষ্ঠিত প্রথম লেগের খেলা ০-০ ব্যবধানে ড্র হয়।

কিন্তু, সোভিয়েতরা পিনোশে’র মানবতা বিরোধী অপরাধের প্রতিবাদস্বরূপ চিলির সান্তিয়াগো স্টেডিয়ামে এওয়ে ম্যাচ খেলতে অস্বীকৃতি জানায়। উল্লেখ্য, স্টেডিয়ামটি পিনোশে সরকার কর্তৃক কনসেন্ট্রেশন (নির্যাতন) ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হত। সোভিয়েত ইউনিয়ন বলেছিল যে মাঠে সাধারণ মানুষের রক্তের দাগ আছে সেখানে ফুটবল খেলা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

অথচ, ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক ফিফা’র সাফ জবাব ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন খেলুক বা না খেলুক, খেলা হবে।

ম্যাচের আগে ফিফার একটি পর্যবেক্ষক দল স্টেডিয়াম পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করতে যায়। ঘুরে ফিরে দেখে তারা স্টেডিয়ামকে খেলার উপযুক্ত হিসেবে সার্টিফিকেট দেয়।

অথচ, সে সময় সকল বন্দীকে স্টেডিয়ামের ভূগর্ভস্থ কক্ষে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। ফিফা’র প্রতিনিধিগণ যখন ঘুরে-ফিরে দেখেছিল তখনও হয়ত বন্দীদের কেউ কেউ আর্ত চিৎকার করছিল। কিন্তু আফসোস! সেটি শোনার জন্য কেউ ছিল না।

নির্দিষ্ট দিন চিলির খেলোয়াড়গণ মাঠে উপস্থিত হল। রেফারি বাঁশি বাজাল। খেলা শুরু হল। চিলির খেলোয়াড় বল নিয়ে প্রতিপক্ষের খালি পোস্টে মেরে গোল করল। কেননা, মাঠে কয়েক হাজার দর্শক থাকলেও, সোভিয়েত ইউনিয়নের কোন খেলোয়াড় ছিল না। ফাঁকা মাঠে গোলের পর রেফারি চিলিকে জয়ী ঘোষণা করল। খেলা শেষ হল।

সেদিন মাঠে উপস্থিত ছিলেন উরুগুয়ের প্রখ্যাত সাহিত্যিক এদোয়ার্দো গ্যালিনো। তিনি বলেছিলেন, ‘এটা ছিল ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ম্যাচ।’

সেই ম্যাচে চিলিয়ান স্কোয়াডে থাকা খেলোয়াড়দের মনোভাবও ইতিবাচক ছিল না। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন কার্লোস ক্যাসেলি। পিনোশে’র আমলে তার আপন মা নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিলেন!

বহুদিন পরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দল যা করেছিল তা ছিল চরম লজ্জাজনক! সারা পৃথিবীর সামনে আমাদের নাক কাটা পড়েছিল।’

মূল পর্বে চিলির প্রথম খেলা হয়েছিল তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির বার্লিন অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। ম্যাচ চলাকালীন বিপুল সংখ্যক বিক্ষোভকারী ব্যানার, ফেস্টুন, স্লোগান দিয়ে প্রতিবাদ করেছিল।

ব্যানারে বড় করে লেখা ছিল – ‘Chile sí, Junta no.’। যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘চিলি ‘হ্যাঁ’, সামরিক জান্তা ‘না’।’

সান্তিয়াগো’র এস্তাদিও ন্যাচিওনাল (ন্যাশনাল স্টেডিয়াম) আজও ফুটবল খেলার জন্য ব্যবহৃত হয়। ২০১১ সালে চিলি সরকার স্টেডিয়ামের একটি অংশকে পিনোশে আমলের নৃশংসতার শিকার হওয়া বন্দীদের জন্য উৎসর্গ করেছে।

গ্যালারিতে বড় করে লেখা আছে – ‘Un pueblo sin memoria es un pueblo sin futuro. (A town without past, is a town without future)। অর্থাৎ যে শহর ইতিহাসকে অস্বীকার করে তাদের ভবিষ্যতও নেই!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link