বক্সিং-বিতর্ক ও উত্থান-পতন

ঢং করে ঘন্টা পড়তেই কুড়ি বছর বয়সী ছেলেটা ঝাঁপিয়ে পড়লো ছাব্বিশ বছর বয়সী জো’র ওপরে। ঘন্টা বাজার পর থেকে জো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছিল পরের সতেরো সেকেন্ড আর এই সতেরো সেকেন্ডে মারতে পেরেছিল মাত্র একটি ঘুঁষি। তাও তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।

কুড়ি বছর বয়সী ছেলেটার ঘুঁষিগুলো জো-র চোয়ালে আছড়ে পড়তে থাকে বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতন। শেষ ঘুঁষিটা ছিল বাঁ-হাতের আপারকাট। ব্যাস, টলমল করতে করতে জো বসে পড়লো। রেফরি তাড়াতাড়ি তার দাঁতের গার্ডটা খুলে নিলেন। পরের মুহূর্তেই পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে সটান চিৎপটাং। নিয়মানুযায়ী  রেফরি দশ গুণে ‘নকআউট’ ডিক্লেয়ার করলেন। প্রথম রাউন্ডেই মাত্র তিরিশ সেকেন্ডে খতম হয়ে গেলো ১৯৮৬ সালের বহু প্রতীক্ষিত জো, অর্থাৎ মার্ভিস ফ্রেজ়ার আর মাইক টাইসনের লড়াই।

মাইকেল জেরার্ড টাইসন। আমাদের বালক এবং কিশোর বয়সের আরেক হিরো। ক্যারিয়ারগ্রাফটা একবার শুনবেন নাকি? শুনুন তবে। মোট ৫৮টি হেভিওয়েট ফাইটে অংশগ্রহণ করেন মাইক। জেতেন ৫০টি। তার মধ্যে ৪৪টিই নকআউট। হেরেছেন ৬টিতে। তার মধ্যে দু’বার হোলিফিল্ডের কাছে। দু’টো লড়াইতে ওয়াকওভার পেয়েছিলেন। প্রতিদ্বন্দ্বীরা আসেইনি।

আনন্দমেলা বা স্পোর্টসস্টার থেকে কেটে ঘরে যখন এমন মারকাটারি তারকার পোস্টার লাগাতে গেলাম, মা রুখে দাঁড়িয়েছিল, ‘কিছুতেই ঐ মারকুটে, গুন্ডা ছেলেটার পোস্টার ঘরে রাখতে দেবো না!’ অগত্যা পড়ার টেবিলে কোন এক বইয়ের ফাঁকেই স্থান হয় চার ভাঁজে ভাঁজ করা মাইক টাইসন।

হেভিওয়েট লড়াইয়ে মোট চুয়ল্লিশ জনকে নক আউট করেছেন আর নিজে নক আউট হয়েছেন তিনবার।

বর্ণময় চরিত্র। বক্সারদের মধ্যে সব থেকে ধনী। যাঁকে বক্সিং দুনিয়ার সম্রাট বলে মনে করা হতো, সেই ক্যাসিয়াস ক্লে ওরফে মোহম্মদ আলঅর রেকর্ড ভেঙে চুরমার করতেও সময় লাগেনি তাঁর।

নকআউটের তালিকায় সব থেকে বেশী সময় ধরে চলে টাইরেল বিগ্সের সঙ্গে লড়াইটা। আন্দাজ করতে পারেন কতক্ষণ চলেছিল? ২ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড। এই নকআউটের তালিকায় ল্যারি হোমস, মাইকেল স্পিঙ্কস, টনি টাকার, ফ্র্যাঙ্ক ব্রুনোর মতন সব সুপারস্টার হেভিওয়েটরা ছিলেন।

প্রথম হারের মুখ দেখেন ১৯৯০ সালে, নিজের ৩৭ তম ম্যাচে, বুস্টার ডগলাসের কাছে। ডগলাসকে তখন বক্সিং দুনিয়া বুড়ো বলে ঘোষণা করে দিয়েছে। তখন তার বয়স তিরিশ আর টাইসন প্রায় চব্বিশ। এক মিনিট বাইশ সেকেন্ডে ডগলাসের বাঁ-হাতের জ্যাবটা বজ্রের মতন আছড়ে পড়ে তার চোয়ালে। মুহূর্তে ধরাশায়ী চ্যাম্পিয়ন।

এরপর আবার শুরু পরপর জয়যাত্রা। ১৯৯৬ সালে তাল কাটে। হার হয় ইভান্ডার হোলিফিল্ডের কাছে। এই হারের সাত মাসের মধ্যে আবার হোলিফিল্ডের মুখোমুখি হন।

নিজের থেকে চার ইঞ্চি বেশী উচ্চতার লৌহমানবের সঙ্গে কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছিলেন না। হোলিফিল্ডের একটার পর একটা ঘুঁষিতে বাঁ-চোখ প্রায় বন্ধ। রিংয়ে যেন ধুঁকছেন তিনি। সেই চিতার ক্ষিপ্রতা উধাও। হলো কী?

তিন নম্বর রাউন্ডে বুঝে গেলেন হার নিশ্চিত। খেলার বয়স তখন তিন মিনিট। পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির টাইসন  জড়িয়ে ধরলেন হোলিফিল্ডকে। জনতা দেখলো হোলিফিল্ডের কানের কাছে তাঁর মুখ। মুহূর্তে হোলিফিল্ড ঝটকা দিয়ে তাঁকে ছিটকে দিয়েছেন। দেখা গেলো হোলিফিল্ডের রক্তাক্ত কান। টাইসন দাঁত দিয়ে কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছেন তাঁর বাম কানের লতি। ডিসকোয়ালিফাই হন। তারপরেও আবার জেতেন। জীবনের শেষ দুটি ম্যাচও হেরেই বিদায় নেন।

২০০৫ এ শেষ ম্যাচ হারেন কেভিন ম্যাকব্রাইডের কাছে। যাঁরা ম্যাচটা দেখেছেন, তাঁরা জানেন ম্যাচটায় পুরনো টাইসনের এক অংশ ছায়াও ছিল না। সেই ক্ষিপ্রতা নেই, নেই সেই পাঞ্চ, সেই আগ্রাসী মনোভাব, নেই লড়াই করতে করতে সমানে নেচে যাওয়া, প্রতিপক্ষকে জিভ ভেঙানো আর তার পরের মুহূর্তেই তার মুখে বাঁ-হাতের সেই বিধ্বংসী জ্যাব।

টাইসন স্বীকার করেছিলেন, লড়াইটা তিনি অর্থ রোজগার করতেই করেছেন। বাজারে তাঁর তখন বহু টাকার ঋণ ছিল। কী করে হলো? এতো ধনী একজন খেলোয়াড়ের ঋণ হলো কী করে?

খেলোয়াড়ি জীবনে বহু বিতর্কে জড়িয়েছেন। নিজের প্রথমা স্ত্রী তথা অভিনেত্রী রবিন গিভেনসকে। এক ঘুঁষিতে নকআউট করে দিয়েছিলেন। গণ্ডগোল কী নিয়ে হয়েছিল, শুনলে অবাক হয়ে যাবেন। সন্তানসম্ভবা রবিনের মিসক্যারেজ হয় আর তারপর থেকেই টাইসন তার ওপর অত্যাচার শুরু করেন। প্রথমে মানসিক আর তারপরে শারীরিক অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।

রবিন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মাইকেলের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি দিন তখন হয়ে উঠেছিল ভয়ঙ্কর। মনে হতো এইবার বোধহয় খুন হয়ে যাবো।’ ১৯৮৯ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। খোরপোশ এবং ক্ষতিপূরণ বাবদ টাইসনকে দিতে হয় একশো পঁচিশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরপরে রবিন ব্র্যাড সিটের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান, সে গল্প অন্য। আর টাইসনও এরপর দুবার বিয়ে করেন।

১৯৯১ এর জুলাই মাসে গ্রেফতার হন টাইসন। এবার অপরাধ আরো গুরুতর। আঠেরো বছর বয়সী এক কৃষ্ণাঙ্গ সুন্দরীকে হোটেলে ধর্ষণের অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। অভিযোগ প্রমাণিত হয়। ছ-বছর জেল হয় তাঁর, শেষে তিন বছর পর প্যারোলে মুক্তি পান।

তাতেও জেল খাটার ভাগ্য শেষ হলো না। আবার গ্রেফতার হলেন ২০০৬ সালে, কোকেন সঙ্গে রাখার জন্য। কিছুদিন পরে আবার মুক্তি।

এখানে আরেকটা বিতর্কিত বিষয় আছে, বলে রাখি। শোনা যায় এই তিন বছরের জেল জীবনকালে তিনি ধর্মান্তরিত হন। তাঁর নতুন নাম হয় মালিক আব্দুল আজিজ। তবে এই তথ্য স্বীকৃত নয়।

টাইসনের সন্তানসন্ততির সংখ্যা আট। টাইসন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি একজন হেরে যাওয়া মানুষ। আমার জীবনে ভালো কিছু ঘটেনি। আমি সব কিছু ছেড়ে পালাতে চাই। ধর্মকর্মে মন দিতে চাই।’

বন্ধুরা, একটা ব্যাপারে আপনারা হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবেন, সাফল্য সকলের মাথাই ঘুরিয়ে দেয়। স্ব-স্ব-ক্ষেত্রে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে নিজেকে সংযত রাখা খুব কঠিন কাজ। ম্যারাডোনা পারেননি, পেলে পারেননি, জর্জ বেস্ট, ব্রায়ান লারা, কাম্বলি, ইমরান খান, ভিভ রিচার্ডস, জন ম্যাকেনরো, রাজেশ খান্না – আরো আছে অজস্র নাম। এই কারণেই শচীন টেন্ডুলকাররা কোটিতে একজনই হন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link