একটি গোল। আর ঐ একটি মাত্র গোলেই অনন্য এক ইতিহাসের মঞ্চায়ন। কি সেই ইতিহাস? আফ্রিকার কোনো দল তখন পর্যন্ত ব্রাজিলকে হারাতে পারেনি। কিন্তু আফ্রিকার দলগুলোর বিপক্ষে অপরাজেয় সেই ব্রাজিলকেই এবার কাতার বিশ্বকাপে ধরাশয়ী করলো ক্যামেরুন। শুধু তাই নয়, বিশ বছর বাদে আবারো কোনো বিশ্বকাপের ম্যাচে জয় পেল তাঁরা।
একটা ম্যাচ জয়ের জন্য বিশ বিশটা বছ! সেটাকে বহুল প্রতীক্ষিত এক জয় না বলে উপায় কই! একই সাথে ব্রাজিলকে হারানোর ঐতিহাসিক এক মুহূর্তের মঞ্চায়ন। এক ম্যাচ জয়েই যেন ক্যামেরুনের সমস্ত চিত্র পাল্টে গেল। ঐতিহাসিক এক দৃশ্যপটে দাঁড়িয়ে গেল আফ্রিকান সিংহরা। আর এমন ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে ক্যামেরুনকে পৌঁছে দেওয়ার নাবিক হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলেন ভিনসেন্ট আবু বকর। ম্যাচের শেষ মুহূর্তে তাঁর হেডেই ক্যামেরুন লিড পায় এবং ১-০ গোলের জয় নিয়ে শেষ পর্যন্ত মাঠ ছাড়ে।
ফুটবল মানচিত্রের ক্যামেরুনকে নিয়ে আলাপ উঠলে স্যামুয়েল ইতো আর রজার মিলার নাম নিশ্চিতভাবেই চলে আসে। এবার সেই দুইয়ের পাশে যোগ হতে পারে আবু বকরের নাম। ১৯৯০ বিশ্বকাপে ক্যামেরুনের রজার মিলার কাছে হেরেছিল আর্জেন্টিনা।
৩২ বছর বাদে, এবার ভিনসেন্ট আবু বকরের কাছে হারলো লাতিন আমেরিকার আরেক দেশ ব্রাজিল। আর স্যামুয়েল ইতো তো ক্যামেরুনকে চিনিয়ে নিয়ে গেছেন ইউরোপেও। খেলেছেন বার্সেলোনার মতো ক্লাবে। বার্সার সোনালি সময়েও তাঁর পদচ্ছাপ ছিল।
একজন লাল কার্ড পেয়ে হাসতে হাসতে মাঠ ছাড়ছে। সম্ভবত ফুটবল ইতিহাসে এমন একটি দৃশ্যও খুঁজে পাওয়া দুস্কর। যে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল ব্রাজিল-ক্যামেরুন ম্যাচে। দারুণ এক হেডে আবু বকর ব্রাজিলের জালে বল জড়ালেন। সাথে সাথেই নিজের জার্সি খুলে ফেলে উদযাপন শুরু করলেন। ফুটবলের নিয়ম মেনে রেফারিও হলুদ কার্ড দেখালেন।
কিন্তু, আবু বকর তো সে ম্যাচেই আরেকটি হলুদ কার্ড পেয়েছিলেন। দুই হলুদ কার্ডে তাই লাল কার্ডের খড়্গ নামলো ভিনসেন্ট আবু বকরের উপর। কিন্তু তাতেও যেন তাঁর কোনো আক্ষেপ নেই। বরং গর্বে ভরা মুখে হাসি নিয়েই মাঠ ছাড়লেন। ছাড়বেন নাই বা কেন। কারণ ততক্ষণে ক্যামেরুনকে ইতিহাসের অংশ করার কাজটা সেরে ফেলেছেন আবু বকর। সেই উদযাপনে একটা লালকার্ড কিইবা আসে যায়!
যাহোক, কে এই ভিনসেন্ট আবু বকর? ব্রাজিল ম্যাচজয়ের নায়ককে নিয়ে এতক্ষণে কম আগ্রহ শুরু হয়নি অনলাইন পাড়ায়। এমনকি এমন ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই ফুটবলারকে নিয়ে আমাদের স্বাভাবিক মননেও অনেক ভাবনার উদ্রেক সৃষ্টি করে। সেই ভাবনার মাঝে কতশত প্রশ্ন, কত কি জানার আগ্রহ!
বে একটি তথ্য জানলে আপনি নিজেও অবাক হতে পারেন। ক্যামেরুনের এই স্ট্রাইকার প্রচুর পড়ুয়া একজন মানুষ। মেটাফিজিক্স নিয়ে তাঁর অন্যরকম জানার আগ্রহ রয়েছে। এমনকি গত এক দশকে তিনি নাকি দর্শনবিদ্যা থেকে শুরু করে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেছেন।
কেউ প্রচুর পড়াশোনা করেছেন, সেটাতে আসলে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। কিন্তু কেউ একজন পেশাদার ফুটবলার হয়েও পড়াশোনায় এত সময় দিয়েছেন, তা ভেবে কিছুটা চোখ কপালে ওঠার মতোই অনুভূতি সৃষ্টি হয় বৈকি।
আরো অবাক করা বিষয় হচ্ছে, তিনি যেখান থেকে বেড়ে উঠেছিলেন সে জায়গাটা কখনোই শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ ছিল না। পরিবেশগত কারণে তাঁর সহপাঠীরা অনেক অপরাধ কর্মের সাথেও জড়িত ছিল। কিন্তু ভিনসেন্ট আবু বকর সেখানে থেকে নিজেকে সবসময় দূরেই রেখেছিলেন। সেটা তাঁর এক সহপাঠী থেকেই জানা যায়। তিনি বলেন, ‘আবু বকর কখনোই আমাদের মতো ছিল না। ওর আলাদা একটা লক্ষ্য ছিল। আর সেই লক্ষ্যকে স্পর্শ করতে সে যথেষ্ট পরিশ্রম করতো।’
একদম ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলতেন আবু বকর। স্বপ্ন দেখতেন কোনো একদিন রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি হায়ে বার্নাব্যুর মাঠ মাতাবেন। সেটি হয়নি। তবে ঠিকই লুসাইল স্টেডিয়ামে ব্রাজিল হারিয়ে পুরো ক্যামেরুনবাসীকেই একদিনে মাতিয়ে দিলেন।
ফুটবল নিয়ে ইউরোপ যাত্রায় আবু বকর কিছুটা দুর্ভাগ্যেরই শিকার হয়েছেন। চেলসিতে কোনো এক সময় খেলার সুযোগ এসেছিল তাঁর। কিন্তু বেশ কিছু জটিলতার কারণ শেষ পর্যন্ত সেই যাত্রা চূড়ান্ত রূপ নেয়নি। একই ভাবে তিনি এটলেটিকো মাদ্রিদ, বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে খেলারও সুযোগ হারিয়েছিলেন।
তবে, ২০১০ বিশ্বকাপের পরে ফ্রেঞ্চ ক্লাব ভ্যালেন্সিয়ানেসে তিনি খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। মাঝে পোর্তোর খেলার পর খেলেছিলেন বেসিকতাসের হয়েও। পোর্তোর হয়ে পাঁচটি মৌসুমে বেশ ভালই ধারাবাহিক ছিলেন তিনি। সেটি প্রমাণ করে তাঁর ১২৫ ম্যাচে ৫৮ টি গোল! এই মুহূর্তে আবু বকর খেলছেন সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসারায়।
ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচজয়ে আবু বকরের গোলটা অবশ্যই তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অর্জন। তবে ক্যামেরুনের জার্সি গায়ে আবু বকর এর আগেও বেশ কিছু কীর্তি দেখিয়েছেন। এ বছরে হওয়া আফকোনে সর্বোচ্চ গোল করে গোল্ডেন বুটের পুরস্কার জিতেছিলেন এই আবু বকর। এ ছাড়া ২০১৭ এর আফ্রিকা কাপ অফ ন্যাশন্স টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন দল ক্যামেরুনের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি।
ব্রাজিলের বিপক্ষে জয়ে ক্যামেরুনের তেমন একটা কাজে আসেনি। কারণ জিতেও পরের রাউন্ডে যেতে পারছে না আফ্রিকান সিংহরা। তবে ক্যামেরুন, নামটার পাশে যে সিংহের ট্যাগলাইন, সেই সিংহের গর্জনটা যে এই বিশ্বকাপে বড্ড প্রয়োজন ছিল।
নিজেরা যে ফুটবল ইতিহাসে একেবারে মাথা নোয়াবার মতো বিলীন হয়ে যায়নি সেটার জানান যে তাদের দেওয়া দরকার ছিল। তাই বিশ্বকাপে পরের রাউন্ড ছাপিয়ে ফুটবল পরাশক্তি ব্রাজিলকে হারানোর মাঝেই আফ্রিকান সিংহরা নিজেদের আনন্দ উন্মাদনা, এমনকি অর্জন খুঁজে নিয়েছে।
এমনিতে দেখতে গেলে, এটা একটা জয় মাত্র। যে জয়ে বিশ্বকাপে তেমন কিছুই বদলে যায়নি। তবে আফ্রিকার ঐ দেশটার কাছে ঠিকই এটা ঐতিহাসিক এক জয়। যে কাজটা আফ্রিকার কোনো দেশ করতে পারেনি সেই কাজটা তারা করে দেখিয়েছে। এমন অনন্য ইতিহাস সৃষ্টিতে তাই অর্জনটা ঠিকই খুঁজে নেওয়া যায়।
আর তাদের এ অর্জনটা যে কত বড় তা তো আবু বকরের উদযাপন দেখেই বুঝা যায়। লাল কার্ড পেয়েছেন। কিন্তু পরম তৃপ্তি নিয়ে মাঠ ছাড়ছেন হাসতে হাসতে। সেই তৃপ্ততার মাঝে দেশ তো আছেই, সাথে নিজের নামটা ইতিহাসের সঙ্গী হয়ে যাওয়াতেও আলাদা একটা মাহাত্ম্য আছে। কারণ, ব্রাজিলকে হারানোর ম্যাচে তিনিই তো নায়ক ছিলেন। সেই কীর্তি আজীবন থেকেও যাবে। মুছে যাবে না।