পেছনের দিনেই লুকিয়ে থাকি জীবনভর

কোত্থেকে শুরু করা উচিত ঠিক ভাবা যাচ্ছে না। যেমন ভাবা যাচ্ছে না কীভাবে ২০২২ সাল এসে গল, কীভাবেই বা কোয়ার্টার অব্দি এসে মরক্কোর কাছে বিদায় নিয়ে অশ্রুসডল চোখে কাতার ছাড়তে হচ্ছে। কথাগূলো রোনাল্ডোর খেলার মতোই ক্যাটক্যাটে। সেই অর্থে ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা নেই।

স্বর্গীয় ডান পা, বল পায়ে কথা বলছে – এমন ভাবনা কেউ কোনওদিন ভাবেনি, বলেনি। আসলে মাদেইরার জেনারেল বেডটার গল্পটাই অন্য। অন্য সবকিছুকে বাঁ হাতে সরিয়ে স্রেফ ফুটবলটা খেলা। কিছু একটা ছিনিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে অবিচল থাকা। সেটাই জীবনের ইমপ্যাক্ট, জীবনের গল্প। আর এ গল্প আচ্ছা-আচ্ছা লিখিয়ের ভাঁজা প্লটের তুলনায় অনেক, অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং।

মাদেইরার জেনারেল বেডের কথা বলছিলাম। অ্যালকোহলিক বাবার পাল্লায় পড়ার আগেই বাবার পৃথিবীকে গুডবাই জানানোটা বড় ধাক্কা ছিলই। আসলে বাবা হারানো অভাগাগুলো যদি হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে যে নিত্যদিনের ঐ মজা-আনন্দের দিনে একটা বিকট কালো ছায়া এসে আছড়ে পড়েছে সংসার মাঝে, ধাক্কা লাগে। খুব ধাক্কা লাগে।

তার আগেও গরীব পরিবারে ক্রিশ্চিয়ানোর জন্ম নিয়ে সন্দেহ ছিল। এতগুলো পেট, চলবে কী করে! কিন্তু ক্রিশ্চিয়ানো জন্মালো। জন্মালো একটা তারা। কেউ বোঝেনি। তারা ঝলসে ওঠার আগে পর্যন্ত কেউ বোঝেনা। মানুষ, মানুষই। অন্তর্যামী নয়। ক্রিশ্চিয়ানোর হার্ট অপারেশন হওয়ার পরেও কেউ যেমন বোঝেনি এ ছেলে ফুটবলটা চালিয়ে যেতে পারবে শুধু নয়, ফুটবল তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে যাবে বহুদূর। অনেক দূরে। যেখানে রুপোর ইউরো কাপের রোশনাই লেগে থাকে।

যেখানে লেগে থাকে আশৈশবের একটা ক্লাসরুম, স্যারের পড়ানোর ফাঁকে হ্যান্ড ফুটবলে স্কোরার হিসেবে ক্রিশ্চিয়ানোকেই বাছাই করা। যেখানে পড়ে রয়েছে আনন্দমেলার কাটিংটা। এআইজির লাল ম্যাঞ্চেস্টারের জার্সিতে রাশিয়ার ঠাণ্ডায় তার মুখ ঢেকে কান্নার ছবিটা কেটে নেওয়া। বিউইন রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে সেই বায়ার্নের এগেন্সটে পাঁচ, পাঁচ আর পাঁচ – পনেরো দেখানো। কেউ জানে না, ঘরের চৌহদ্দির একটা কোণ থেকে অবহেলায়, অনাদরে পড়ে থাকা সেই কাটিংগুলোতে পরম যত্নে হাত বোলাচ্ছিলাম।

আমার ম্যানচেস্টারের সেই বাবার কিনে দেওয়া এআইজি জার্সিটা একবার গলিয়ে নিলাম। ক্রিশ্চিয়ানো নিজেও কি জানেন? ঐ স্পর্ধা জাগানোর দিনগুলো কেমন ফিরিয়ে আনছিলাম আমি নিজে? ওয়ো কামাল কে দিন থে – বলতে বলতে কেমন নিঝুম হয়ে পড়ে রাতের স্ট্রিটলাইটগুলো। আর্সেনালের বিরুদ্ধে কত দূর থেকে একটা ফ্রি-কিক পাল্টে দিল ওয়েঙ্গারের মুখের রেখা। ক্যারিংটনে উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন স্যার ফার্গুসন। রোনালদো জোরালো শটে গোল করলেন নিউক্যাসলের বিরুদ্ধে।

বাবা মারা যাওয়াটা আদ্রিয়ানোর কেরিয়ারের সবচেয়ে বড় ধাক্কা। মনের ঘরে বাসা বেঁধে ফেলা প্লেয়ার যখন ধীরে ধীরে দূরে চলে যায়, তাকে বিদায় জানানোর জন্য হাতটাও ওপরে ওঠে না। সেই বাবা মারা যাওয়ার পরে হাড়ভাঙা ট্রেনিংয়ের মধ্যে শুধু একবার ছুটি চেয়েছিল আমাদের ক্রিশ্চিয়ানো। নিস্টলরয়ের জঘন্য রসিকতা থেকে খানিক মুক্তিরও দরকার ছিল। তেভেজ বলেছিলেন, ‘একদিন ভোর সাড়ে চারটের সময়ও ক্যারিংটনে এসে দেখি সে শুয়ে আছে স্পাইক পরে!’

ক্রিশ্চিয়ানো কী করেছে এই ২০০৩ থেকে ২০২২ পর্যন্ত, তামাম দুনিয়া গত ঊনিশ বছর ধরে একটা জাবদা খাতায় সেসব হিসেব তুলে রেখেছে। লাখ লাখ পাতা শেষ হয়ে গেছে শুধু রেকর্ড লিখতে গিয়েই। ৪০০ গোলের পর আমাদের স্কুলে একটা রসিকতা ছিল, এবার প্যাপিরাস কেটে পেপার বানিয়ে রেকর্ড লিখতে হবে। সেই রোনালদো ক্যারিয়ারের প্রায় সায়াহ্নে এসে করলেন ৮০০ গোল। কী নাম দিই এই জার্নির?

মরক্কোর কাছে হারের পর ক্রিশ্চিয়ানো কাঁদছে। আমার বাবা বলতেন, ‘যে সিনেমায় ধর্মেন্দ্র কাঁদে, সেই সিনেমা দেখা যায় না।’ ক্রিশ্চিয়ানো নিজে একটা সিনেমা। একটা হারিয়ে যাওয়া রাত, একটা মেরুন কালারের ১৭ নম্বর জার্সি। রুনির দিকে তাকিয়ে চোখ মারা। অনেক, অনেক উদ্ধত। ফ্রাস্ট্রেটেড অবস্থায় দেশের ক্যাপ্টেনস আর্মব্যান্ড ছুঁড়ে ফেলার পর যার মধ্যে এতটুকু অনুশোচনা কাজ করে না। যেমন ওজিলের ঠিকানা লেখা পাসগুলো লেফট চ্যানেল থেকে ইনসাইড ডজে প্রতিপক্ষের গোলে জড়িয়ে ‘কাম ডাউন, আই অ্যাম হিয়ার’ সেলিব্রেশন করতেও দ্বিধাবোধ নেই।

রাইভ্যালরি কোন মাত্রায় পৌঁছলে পরে ক্যাম্প ন্যুতে জার্সি খুলে দর্শকদের দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে থাকা যায়, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো তার আদর্শ উদাহরণ। পাঁচটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালের মধ্যে চারটে ফাইনালে গোল রয়েছে যার। সেই প্রথম গিগসের ক্রসে স্পটজাম্প হেডে পিটার চেককে ধরাশায়ী করা। সেই ফাইনালের পেনাল্টি শুটআউটে মিস করে জেতার পর হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্না। জীবন সেবার বাঁচিয়ে দিয়েছিল আগামীর তারকাকে লালন করতে।

১৩ বছর পর সেই ক্রিশ্চিয়ানো বেঞ্চে বসে নীরব যোদ্ধার মতো, সেই মাদেইরার বড়দের ফুটবলের ম্যাচগুলোর মতো একটা চান্সের অপেক্ষায় করুণ চোখে তাকিয়ে থাকেন কোচের দিকে। কিন্তু এই ক্রিশ্চিয়ানো কোচের সাথে ঝগড়া করেন। আবার এই ক্রিশ্চিয়ানো সদ্য পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করা সন্তানের শোককে বুকে চেপে মাঠে নেমে পড়েন নতুন কিছু প্রত্যাশার আশায়। ক্রিশ্চিয়ানো, ক্রিশ্চিয়ানো – যে নিজেই একটা সাক্ষাৎ উপন্যাস। কোনও নামজাদা লিখিয়ের ক্ষমতা নেই এমন একটা প্লট তৈরি করার।

সেই ক্রিশ্চিয়ানোকে বুড়ো বলতে মুখে কোলাপসিবল লাগে। কাঁদতে দেখলে টিভি অফ করে দিই। শৈশবের নায়কগুলো মঞ্চ একদিন ছেড়ে যাবেই, প্রকৃতি শিখিয়ে দেয়। কিন্তু ক্রিশ্চিয়ানোকে কেন জানিনা কাঁদতে অন্তত দেখতে পারিনি। তাই সেদিন খেলা শেষ হওয়ার সাথে সাথে টিভি অফ করে ছাদে চলে যাই।

আর দেখি, ঐ স্যার ফার্গুসন চুইংগাম চিবোচ্ছেন। দূরে ওয়ার্ম আপ সেরে নিচ্ছে রুনি, গিগস আর নানি। ডিফেন্স লাইন মেপে নিচ্ছে ভিদিচ, ফার্দিনান্দ। আর একেবারে লেফটে রোনাল্ডো কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রেফারির হুইসলের প্রতীক্ষায়।

একটা বাঁশি, একটা নতুন স্বপ্ন, নতুন বাসনা, দুর্নিবার আকাঙ্খা, প্রথমে থেকে যাওয়ার অদম্য জেদ। গোল, কাট ইন, স্টেপওভার, পেনাল্টি আর সেলিব্রেশনের অন্য মেজাজ। রাজা চলে গেলেন, মুকুট পড়ে রইল। এই তো জীবনের ছন্দ… ক্রিশ্চিয়ানো, শিখতে পারলাম না। লিখতেও পারলাম না গুছিয়ে। চলে যাওয়ার দিনে সব কেমন ওলটপালট হয়ে যায়। উনিশ বছর তো… শুধু আমার জন্য এই জীবনে কী যে রেখে গেলে ক্রিশ্চিয়ানো, তা না হয় আমার ঐ খাতার পেছনের দিনগুলোতেই লুকিয়ে থাকুক জীবনভর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link