ইংল্যান্ডকে নিয়ে লিখতে গিয়ে ভীষণ কনফিউজড। যে জন্য গালাগাল করলাম ব্রাজিলকে যে প্রাচুর্য থাকার পরেও শুধুমাত্র মানসিক কাঠিন্য এবং ম্যাচ সিচুয়েশনে সময়মতো রিয়্যাক্ট করতে না পারার খেসারত দিতে হল। একই কথা তো ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রেও বলা যায়। তাও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে, চ্যানেল ডার্বিতে।
অথচ ইংল্যান্ড আর ব্রাজিলের ফুটবল দর্শন একেবারেই বিপরীত। তিতের ক্ষেত্রে যদি বলা যায় যে ঠিক সময়ে ঠিক ভাবনাটা ভাবেননি, গারেথ সাউথগেটের ক্ষেত্রে বলতে হয় বেশি ভেবে ফেলে মুশকিলে পড়লেন। অবশ্য ম্যাচের ৮৪ মিনিটে পেনাল্টি নষ্ট হলে কী করবেন কোচ!
ফ্রান্সের সঙ্গে ম্যাচটা সবসময়ই দেশঁ এবং সাউথগেটের ট্যাকটিকাল লড়াই ছিল। কিলিয়ান এমবাপ্পে বা জুড বেলিংহ্যাম তো একএকটা বোড়ে, কোচ বললে তবেই রাজা উজির মারেন।
তবে কিলিয়ানকে এই ম্যাচে অধিকাংশ সময়ই কাইল ওয়াকার পকেটে পুরে রেখেছিলেন। যেটা সাধারণত: দেখা যায়। কাইল নিজের সময়ের সেরা রাইট ব্যাক, গতি ও শক্তির সঠিক মিশ্রণ। কিন্তু চোট থেকে ফিরে আসার পরে গতি কমেছে বটে।
শুরুতে আক্রমণে ইংল্যান্ডের বাঁদিকে ওভারলোড ছিল। ল্যুক শ একটু নিচ থেকে শুরু করছিলেন বলে ডেম্বেলে নিচেই থাকছিলেন, ফডেন জুলস কুন্ডেকে টেনে নিয়ে গেছেন সাইড লাইনের দিকে, ভারান আর কুন্ডের মাঝের জায়গাটা দেখার জন্য চৌমেনি পিছনে আসতে বাধ্য হচ্ছিলেন কারণ ওই জায়গাটায় বেলিংহাম অপারেট করছিলেন।
আর কেইন নেমে এলে ওভারলোড হয়ে যাচ্ছিল, তখন র্যাবিয়কে বাঁদিকে ঢলে পড়তে হচ্ছিল, থিওর ডিফেন্সিভ এবিলিটি বা ইচ্ছা দুটোই কম, কিলিয়ান নিচে নামেন না। ফলস্বরূপ বারবার সাকা ওয়ান ভার্সেস ওয়ান হয়ে যাচ্ছিলেন, সেটা ব্যবহার করার ভরপুর সুযোগ ছিল।
কিন্তু সাউথগেট সিস্টেমের দাস। তাঁর প্লেয়াররাও। এইখানেই স্টার্লিংকে মিস করেছেন তিনি, কেন বরাবর ফাঁদ হিসাবে ব্যবহৃত হন। কেন নিচে নেমে আসেন একটা সেন্টারব্যাককে সঙ্গে নিয়ে হোল্ডআপ প্লের জন্য, আর পিছন দিয়ে স্টার্লিং কাট ব্যাক করে গোল করে যান। এখানে নির্ভর করতে হচ্ছিল, বেলিংহাম ও সাকার উপর।
আর ফ্রান্স আক্রমণের সময়, যে হেতু ডানদিকের ওভারলোড ছিল, গ্রিজমানের অপারেট করতে সুবিধা হচ্ছিল কারণ শকে ডেম্বেলে টেনে নিচ্ছিলেন নিজের দিকে, তার ফলে আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করছিলেন গ্রিজমান।
প্রথম গোলটার ক্ষেত্রে কিলিয়ান ভিতরে ঢুকে আসেন ফলে ডিফেন্সিভ সেটআপ নড়ে যায়। রাইস কভার করছিলেন গ্রিজমানকে, এমব্যাপের সঙ্গে লেগে ছিলেন শ এবং ডাবল কভার হিসাবে ছিলেন ম্যাগুইর। এই যে মাঝখান দিয়ে একটা গ্যাপ তৈরি হল এবং চৌমেনির কাছে বল গেলে ম্যাগুইর সামান্য দেরি করেন ফাঁকটা ভরাট করতে। ফ্রান্স ১-০।
১-১এর ক্ষেত্রে দেখবেন, থিও ট্র্যাক ব্যাক করতে দেরি করেছেন সাকার সঙ্গে র্যাবিয়ট। তারপর সাকা কাট ব্যাক করলেও থিও টার্নিং-এ দেরি করেছেন এবং শেষমেশ চৌমেনির লেট ট্যাকল।
আগেও বলেছিলাম যে বেনজেমা না খেলায় গ্রিজমান ও জিরুর সহায়তায় কিলিয়ান এমব্যাপের খেলা খুলবে। শুধু কিলিয়ান নয়, গ্রিজমান ও জিরুও দুর্দান্ত ফর্মে আছেন। ফল স্বরূপ দেখা যাচ্ছে ফ্রান্স এখন নানা চোট আঘাতের পরে যে ‘ওয়েফার থিন’ দল নিয়ে চলছে সেটাই কাজ করে দিচ্ছে।
আর সঙ্গে রয়েছে দিদিয়ের দেশ্যমের গেমরিডিং। দুই মিডফিল্ডার অফকালার বল উপরে পৌঁছচ্ছে না, এখানে ভারান স্টেপ ইন করলেন। রাইস ও হেন্ডারসন মিড ব্লকে থাকছেন, তাই ভারান নিচ থেকে খেলা তৈরি করার দায়িত্ব নিলেন। এরিয়াল থ্রেট সামলাবার দায়িত্ব উপমেকানোর।
গ্রিজমানের বাঁ দিক থেকে ক্রসে ফ্রান্সের দ্বিতীয় গোলটার ক্ষেত্রেও স্টোন্স ও ম্যাগুয়েরেরর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করায় জিরুড মেরে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
ইংল্যান্ড আবার খেলাটা ধরে দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি থেকে, গোলটা খেয়ে গেলেও। স্টার্লিং নেমেছেন, গ্রিলিস বাঁ দিক থেকে ড্রিবল করছেন, হেন্ডারসনের জায়গায় মাউন্ট। মাউন্টকে যে ফাউলটা থিও করলেন সেটা বেশ বাজে ফাউল। কিন্তু কেনের কপাল। বা সাউথগেটের কপালও বলা যায়।
হ্যারি কেন পৃথিবীর অন্যতম সেরা পেনাল্টি শ্যুটার। তিনি একটা স্পট বেছে নেন এবং চোখ কান বুজে সেখানে তেড়ে মারেন। গোলকিপারের কিছু করার থাকে না। এবারেও তাই ছিল। কিন্তু সামান্য টেকনিক এবং কপালের হেরফেরে বল উড়ে যায়। উড়ে না গেলে হয়তো অতিরিক্ত সময়ে ইংল্যান্ডই।
ইংল্যান্ড বা ব্রাজিল এদের পরিস্থিতি বেলজিয়াম বা ক্রোয়েশিয়ার মতো নয়, স্বর্ণ প্রজন্ম চলে গেলে যাদের উঠতে সময় লাগবে। কিন্তু টুর্নামেন্ট ফুটবল বিশেষত নকআউট ফুটবল একটু অন্যধরণের। এখানে আপনাকে বেটার ফুটবল খেলতে হবে না, প্র্যাগম্যাটিক চিন্তাভাবনা রাখতে হবে এবং আসল কাজটা সঠিক সময়ে করতে হবে। গত বিশ্বকাপে সেমি ফাইনালে লিড রেখে, ইউরোতে ফাইনালে লিড নিয়ে এবং এই বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিটদের বিরুদ্ধে অনেক ভালো ফুটবল খেলেও বিদায় নিল ইংল্যান্ড।
পরপর দুই দিন এই বিশ্বকাপের সেরা দুটি সম্ভাবনা ফুরিয়ে গেল। পর্তুগালের না হয় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো নামের একটা ভীষণ বড় দোধারি তলোয়ার ছিল, কিন্তু ব্রাজিল ইংল্যান্ডের তো ছিল না। টিম স্পিরিট দুর্দান্ত, টেকনিকালি গিফটেড কোচ, প্রতিভার ছড়াছড়ি। তবুও সঠিক সময়ে জ্বলে উঠতে না পেরে বাড়িতে বসে সেমিফাইনাল দেখতে হবে। দুদলই হয়তো কোচ বদলাবে। দেখা যাক নতুন কোচরা ব্রাজিল বা ইংল্যান্ডের মানসিকতার উন্নতি করতে পারেন কি না!