আমার দিবস কাটে বিবশ হয়ে তোমার চোখে চেয়ে!

কতশত হতাশার গল্প। এই ফুটবল বিশ্বের প্রায় সবকিছুই তো জিতেছেন তিনি। তবুও যে কোন এক সময় তাঁর উপর এসে ভর করেনি বিষন্নতা, সে নিশ্চয়তা দেবে কে? অবশ্যই বহুবার হানা দিয়েছে বিষাদ।

২০১৪ বিশ্বকাপের অপ্রত্যাশিত এক গোলে স্বপ্ন ভঙ্গ, এরপর ২০১৬ কোপা আমেরিকার ফাইনালটায় পেনাল্টি মিস করে আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়ের পথটা আরও লম্বা করেন লিওনেল মেসি। হতাশার দীর্ঘ যাত্রা চলতে থাকে। প্রতিটা ক্লান্তিকর এক দিন শেষে সব পাখি নীড়ে ফেরে।

লিওনেল মেসি সেটার ব্যতিক্রম নন। অ্যান্তোনেলা রোক্কুজ্জো পরম মমতা, ভালবাসা আর আদরের স্নিগ্ধ স্পর্শে সর্বদা আগলে রেখেছেন এই পৃথিবীর ফুটবল ইতিহাসের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রকে। কত সমালোচনা দুই জনে মিলে সয়েছেন! কত অন্ধকার সময় পার করেছেন! তবুও হাল ছেড়ে দেননি। অবশেষে দুই জনে মিলে আনন্দ অশ্রু ঝড়ালেন কাতারে। মরুভূমির শুষ্ক বালুকণাও যেন শত অপেক্ষার অশ্রুজলে খানিকটা প্রশান্তি খুঁজে নিলো।

পৃথিবীর কি অদ্ভুত নিয়ম। একটা সময় এই অশ্রুগুলোই তো কতটা বিষাদের জন্ম দিয়েছিল। এই বিষাদই ছাপিয়ে আজ মেসি চ্যাম্পিয়ন, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন! সম্ভবত মেসির জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। মেসির জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। এই দিনেও মেসি ভুলে গেলেন না তাঁর সাথী অ্যান্তোনেলা রোক্কুজ্জোকে। দর্শক সারি থেকে ডেকে এনে দু’জনে মিলেই উল্লাস করলেন। জড়িয়ে ধরে হয়ত মেসি বললেন, ‘আমি পেরেছি অ্যান্তোনেলা! আমি জিতেছি!’

সে সময়টায় কবি কাজী নজরুলের এক কবিতার পঙক্তি খানিক মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে এই বাংলার সবার। বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

এখানে কবির ভাবার্থ ভিন্ন হয়ত। তবুও আলিঙ্গন করা সে দৃশ্য বর্ণনায় এই লাইন গুলো যথার্থই। ক্ষুদে মেসি, যখন দৌড়ে বেড়ান রোজারিওতে ঠিক সে সময়টা থেকে মেসির হাতটা ধরেছিলেন অ্যান্তোনেলা। শক্ত করেই ধরেছিলেন।

শত ঘাত-প্রতিঘাত, ঝড়-ঝাপটায় তাঁরা দুইজন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা রেললাইন। বিশ্বজয়ের গাড়ি ছুটে গেলে যার উপর দিয়ে উদ্দ্যম গতিতে। ২০০৯ সাল, মেসি তখন উদীয়মান। কেউ ভাবেনি তিনি এতটা বর্ণিল রঙে রাঙিয়ে যাবেন গোটা ফুটবলের ইতিহাসকে।

অনিশ্চয়তার উর্ধ্বে গিয়ে মেসি জানিয়ে দিলেন নিজের ভালবাসার কথা। কল্পনার জগতে হয়ত মেসি অ্যান্তোলিনা কে জিজ্ঞেস করে বসলেন, মেয়ে, তুমি এখনও আমায় বন্ধু ভাবো কি? কখনো কি আমায় ভেবেছিলে বন্ধুর চেয়ে একটুখানি বেশি?

বন্ধুত্ব দিয়ে শুরু হওয়া সম্পর্কটা, সময়ের পরিক্রমায় হয়েছে গাঢ়। মেসির জীবনের অন্যতম অনুপ্রেরণা হয়ে প্রতিটা স্মৃতিতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রইলেন অ্যান্তোনেলা। ক্ষুদে সেই মেসিকে এই অবিশ্বাস্য এক জাদুকর হবার অনুপ্রেরণা নিশ্চয়ই তিনি দিয়ে গেছেন।

স্বস্তির জায়গাটুকু হয়ে রয়ে গেছেন। রাজ্যের চাপ সহ্য করে হাঁপিয়ে ওঠা লোকটার দম ফেলবার একটা জায়াগা হয়ে রইলেন অ্যান্তোনেলা। দু’জনে মিলে কত রাতের আলাপে শুধু এই দিনটির কথাই চিন্তা করেছেন তার ইয়ত্তা নেই।

ফুটবলটাকে মেসি ভালবেসেছেন নিজের চাইতেও বেশি। অ্যান্তোনেলা তা নিয়ে অবশ্য খুব একটা আপত্তি জানাননি। তিনিও বরং ভিনগ্রহের প্রাণিটিকে বলে গেছেন, ‘আমিও তোমার মত করেই ফুটবলকে ভালবাসি।’ এই দুই যুগলের সম্পর্কে ভাটা পড়েনি। পড়েছে হয়ত, তবে লোকচক্ষুর আড়ালে।

প্রতিটা সম্পর্কেই তো উত্থান আর পতন থাকে। নতুবা তা সম্পর্ক হয় কি করে! তবুও তাঁরা দীর্ঘ একটা পথ একসাথে পাড়ি দিয়েছেন। মেসি চাইলেও আর পাঁচটা ফুটবলারদের মত ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে পারতেন। তবে না তিনি তা করেননি।

তিনি বরং ২০১৭ সালে এসে অ্যান্তোনেলাকে নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে চিরদিনের জন্য স্বীকার করে নিলেন। ঠিক এরপর থেকেই যেন মেসির ভাগ্যের চাকাটা দ্রুত গতিতে ছুটতে থাকে। ক্লাব পর্যায়ে মেসির আর কোন কিছুরই অপূর্ণতা ছিল না।

যা ছিল সব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে। সেই  আক্ষেপ আর অপূর্ণতা ঘুচে যেতে থাকল। ২০২১ সালে মেসি জিতে নিলেন কোপা আমেরিকা, ২০২২ এ ফিনালিসিমা। আর ২০২২ এর শেষ বেলায় বিশ্বকাপ শিরোপা।

আর কোন অপূর্ণতা নেই, আর কিছুর আক্ষেপ নেই। লিওনেল আন্দ্রেস মেসি, তাঁর জীবন সার্থক। অ্যান্তোনেলা রোক্কুজ্জোর মত একজন সহধর্মিণী, বিশ্ব ফুটবলের যতসব অর্জন আর থিয়াগো, মাতেও এবং চিরোর মত সন্তানদের দিয়ে তাঁর ঘর আলোকিত।

মেসি বিশ্বকাপ ট্রফির আগে চুম্বন এঁকে দিয়েছিলেন তাঁর প্রেমিকা, তাঁর অর্ধাঙ্গিনী অ্যান্তোনেলা রোক্কুজ্জোর ঠোঁটে। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন তো অ্যান্তোনেলা। যিনি সাহস জুগিয়েছেন, বন্ধুর পথ একসাথে পাড়ি দিয়েছেন। বিষণ্ণ রাতগুলোতে আস্থার পরম স্পর্শে চুলে বিলি কেটে দিয়েছেন। মেসি এই সবকিছুই নিয়েই পরিপূর্ণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link