কিছুই আশ্চর্যের নয়। একটা বিল্ড আপ তৈরি করতে সময় নিয়েছে ২০ বছর মাত্র। ডাভর সুকেরদের জমানা চলে গিয়ে স্রান, কোভাচ, টুডর, দারিও সিমিচ আর তরুণ মদ্রিচের সেই ২০০৬-এর টিম ভুগেছিল মাঝমাঠে আর ফিনিশিংয়ে। তারপর ধীরে ধীরে একটা স্ট্রাকচার তৈরি করে এফেক্টিভ বিল্ড আপ তৈরি হয়েছে। বেশিরভাগ যে প্লেয়ারগুলো দিনেমো জাগ্রেবের মতো ছোট ক্লাব থেকে উঠে এসেছে, তাদের বেশিরভাগ বর্ডার ক্রস করে ইউরোপ কন্টিনেন্টেই নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তার সুফল গত ৮ বছর ধরে পাচ্ছে যুদ্ধের পরে ভাগ হওয়া ঐ ছোট্ট লাল-সাদা দেশ ক্রোয়েশিয়া।
যেমন মদ্রিচ। যেমন কোভাকিচ, যেমন ম্যানজুকিচ, পেরিসিচ, রাকিটিচ, ব্রজোভিচ, লভরেন। পরপর প্লেয়ার উঠে এসেছে টিমটায়। আর সবকটা ট্যালেন্টকে একটা সুতোয় বেঁধে একেবারে পারফেক্ট ম্যানেজারের মতো কাজ করিয়ে গেছেন জ্লাটকো ডালিচ। লোকটার অসাধারণ গেম রিডিং। প্লাস, ২০১৪-তে যে টিমটা ছিল ক্রোটদের, তাতে ইয়ং এবং নন-এক্সপিরিয়েন্সড প্লেয়ারের সংখ্যা বেশি ছিল।
ফলে বেশিদূর সেবার এগোতে না পারলেও ২০১৮-তে ডালিচের হাতে পড়ে ফিরে এল বাঘ হয়ে। ৪-২-৩-১ এ জোন ১৪-তে সেবার রিয়ালের হয়ে ক্লাসিক সিজন কাটানো মদ্রিচ তাজা ঘোড়া হয়ি উঠেছিল। বাঁয়ে পেরিসিচ আর ডানে রেবিচ মিলে অ্যাটাকিং ডুয়ো তৈরি করেছে যার ঠিক নিচে মদ্রিচ, আবার মদ্রিচের নিচে সেকেন্ড বল আর পিভটের জন্য ব্রজোভিচ। যদিও এবারের এ টিমটায় ওভারল্যাপিং উইংব্যাক হিসেবে জুরানভিচ আর সোসোর মতো পেয়ার পেয়েছিলেন ডালিচ কিন্তু ঐ টিম নিয়েও ৪-১-৪-১ এ খেলার সাহস দেখিয়েছিলেন।
কারণ টিমটার অ্যাভারেজ বয়স এবারের তুলনায় কম ছিল, লেফট পিভট হিসেবে পেরিসিচ অতুলনীয় ছিল, রোয়িং ক্যাম আর বক্স টু বক্স মিডে লিঙ্ক আপ প্লে-টা মদ্রিচ ঐশ্বরিক খেলেছিল আর মারিও ম্যানজুকিচের মতো ওয়ান অফ দি গ্রেটেস্ট ফিনিশার ছিল টিমটায়। লভরেন উচল হারলেও পারফর্ম অসাধারণ করেছিল। সর্বোপরি সুবাসিচের মতো তুখোড় রিফ্লেক্স আর দূরের শটে দারুণ স্টপার একটা কিপার ছিল ওদের। রাশিয়া-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচটা নিশ্চিতভাবে অনেকের মনে থাকা উচিত।
তো যাই হোক, এই টিমটায় কিন্তু সেসব ছিল না। এখন মদ্রিচ ১ ইস্টু ২-তে বল বার করে নিলেও সামনে ক্র্যামারিচের কাছে দুটো প্রবলেম। অফসাইড ট্র্যাপ ভাঙতে না পারা এবং নিচে নেমে এসে আপে স্পেস খুলতে না পারা। ফিনিশিংয়ে প্রবলেম, ক্লিনিক্যাল নয় প্লাস ক্র্যামারিচ ততটা ফিজিক্যাল নয়, ক্লাসিক্যাল নাম্বার নাইন তো নয়ই। অনেকটা পোচার টাইপ।
যার ফলে অ্যাটাক বারবার তৈরি হয়েছে জুরানভিচ থেকে প্যালাসিচ বা সোসো থেকে পেরিসিচ। আর এই দুটো স্ট্রিং বাজিয়ে যাওয়াটা ধরে রেখেছিল মদ্রিচ আর ব্রজোভিচ। মুশকিলটা হল, আর্জেন্টিনা ম্যাচে মাঝমাঠে বল ধরলে দু’জনেই দেখছে দু’জনের কাছেই দুটো করে ম্যান এসে পড়ছে। ফলে বাঁয়ে পেরিসিচকে সারাক্ষণ ওপর-নিচ করতে হল। প্যালাসিচ ক’টা বল পেয়েছে হাতে গুনে বলা যায় আর ম্যানজুকিচের মতো গোলটা ব্যাপক চেনা ফরোয়ার্ড না থাকায় ভুগতে হল।
কিন্তু তা সত্বেও থার্ড! কেন? এই কাপে টিমটাকে টেনে নিয়ে গেছে মাঝ, ডিফেন্স আর কিপার। অর্থাৎ, কোভাকিচ-মদ্রিচ-ব্রজোভিচ, সোসো-লভরেন-গ্যাভারদিওল-জুরানভিচ। তারপর লিঢাকোভিচ। আউটস্ট্যান্ডিং ডিফেন্স লাইনটা এবারে হাতে পেয়েছিলেন ডালিচ আর আপের মুভে জুরানভিচকে সুন্দর লেলিয়ে দিলেন। ফল? কানাডা ম্যাচে বেশিরভাগ আক্রমণ মদ্রিচ-জুরানভিচ হয়েই সুইচ। ৪-৩-৩ অন পেপার ফর্মটা মাঠে অ্যাটাকের সময় ২-১-৫-২ হয়ে যাচ্ছিল। ঐ ৫-এর মধ্যে এই ৩৭ বছর বয়সে একটা লম্বা চুলওয়ালা ডান পায়ের বুড়ো কী সুন্দর লিঙ্ক করাচ্ছে। আর কি চাই! ক্রোয়েশিয়া থার্ড তো হল। রেকর্ডে লেখা তো হয়ে গেল।
মদ্রিচের ক্যাপ্টেনসিতে ঐ ছোট্ট দেশটা বিশ্বকাপে একবার রানার্স, একবার থার্ড। কাহিনীর শেষে বিজয় নেই। খুব মনে পড়ছে ছিছোরের শেষ ক’টা লাইন। ‘আপকা তো কুদ যানে কা মন কিয়া থা না?’ উত্তরে এসেছিল, ‘নেহি। কিঁউকি উস দিনকে বাদ সে হাম কভি লুজার রহে হি নেহি।’
মদ্রিচের চলে যাওয়া নিয়ে ব্যথাটা ব্যক্তিগত। আর প্রকাশ করতে ভাল লাগছে না। এক জীবনে দেখে তো নিলাম। ফুটবল দেবতা এই দুটো চোখকে অনেক দিয়েছে, দিয়ে যাচ্ছে। মদ্রিচের কাহিনীটা আবার খুলে বসব কখনও যখন কেউ আবার ২৬-২৭ গজ দূর থেকে আউটস্টেপে পাস দেবে। হেয়ারব্যান্ড ঠিক করে, বডিটা আলতো কৌণিক ভাবে দুলিয়ে বলটা ফাঁকে ফেলে বার করে থ্রু দেবে। যেমন ব্রাজিলে একজন বল পেলে ব্যাপক জোরে দৌড়ত আর কবিতা লেখার মতো লম্বা থ্রু বাড়াতো, তেমনই। সেদিন না হয় আবার কেউ একজন ছিল বলে।
ঐ যা হয় আর কি। নিয়ম যেটা বলে। বয়স-টয়স বাড়লে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। গুড জব মদ্রিচ, জ্লাটকো ডালিচ। গুড জব ক্রোয়েশিয়া। জার্নি কামস টু অ্যান্ড এন্ড।