এমবাপ্পে, ফরাসি না আফ্রিকান!

বর্তমান ফুটবল বিশ্বে উদীয়মান তারকাদের একজন কিলিয়ান এমবাপ্পে। সন্দেহ নেই, অবকাশও নেই। নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায় মেসি-রোনালদো পরবর্তী যুগে ফুটবল ভক্তদের আনন্দে মাতাতে একা কিলিয়ান এমবাপ্পেই যথেষ্ঠ। তিনি একা ঠিক কতটা ভয়ংকর তা টের পেয়েছে গোটা আর্জেন্টিনা দল। বিশ্বকাপের ফাইনালে হ্যাট্রিক করা দ্বিতীয় খেলোয়াড় কিলিয়ান এমবাপ্পে। প্রথম ঘটনাটা ৫৬ বছর আগের।

তবুও একরাশ হতাশা নিয়ে তাঁকে ছাড়তে হয়েছে মাঠ। দ্বিতীয় দফা বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নের অপেক্ষাটা আরও দীর্ঘায়িত হল ফ্রান্স তথা কিলিয়ান এমবাপ্পের। তবে এই যে সাফল্যের গল্পের প্রধান চরিত্র হওয়া কখনোই হয়ত হয়ে উঠত না এমবাপ্পের। কেননা কার্যত তাঁর সামনে সুযোগ ছিল তিনটি ভিন্ন দেশের হয়ে ফুটবলে প্রতিনিধিত্ব করা। সিদ্ধান্ত নেওয়াও ছিল বেশ কঠিন এক কাজ। তবুও শেষ অবধি তিনি বেছে নেন লেস ব্লুসদের জার্সি। আর তার পরের গল্প তো সবারই জানা।

এমবাপ্পের মা ছিলেন একজন ভলিবল খেলোয়াড়। আর বাবা ছিলেন স্থানীয় ক্লাবের একজন ফুটবল কোচ। ক্রীড়ার সাথে এমবাপ্পে পরিবারের মেলবন্ধনটা বহু আগে থেকেই বিদ্যমান। খেলাধুলার সেই জিনটা জন্মলগ্ন থেকেই ছিল এমবাপ্পের মাঝে। ছেলে বেলা থেকেই তিনি ফুটবলটাকে আকড়ে ধরেন। তাঁর ছোট্ট ঘরটার দেয়াল জুড়ে জায়গা করে নেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। সেই বাল্যকাল থেকেই শুরু দুরন্তপনা। ছেলেবেলা থেকেই তিনি আলো কাড়তে শুরু করেন।

ফুটবলের কৌশলগুলো বুঝে ওঠার আগেই তাঁকে দলে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল স্প্যানিশ ও ইংলিশ জায়েন্ট দুই ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ও চেলসি। তাদের যুবদলের হয়ে এমবাপ্পেকে অনুশীলন করবার সকল সুবিধাসহ, এমবাপ্পের পরিবারের সমস্ত খরচ বহন করতেও তৈরি ছিল ক্লাবগুলো। তবুও মন টলেনি এমবাপ্পের বাবা উইলফ্রেড এমবাপ্পের। তিনি তাঁর ছেলের সক্ষমতার একটা ধারণা নেওয়ার উদ্দেশ্যেই বরং তাঁকে বিভিন্ন ক্লাবে ট্রায়াল ক্যাম্পে নিয়ে যেতেন।

যেহেতু তিনি ফুটবলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, তিনিই এমবাপ্পের সকল সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছেন। এখন তো তিনি বনে গেছেন ২৪ বছর বয়সী এই তারকার এজেন্ট। এমবাপ্পের বাবা উইলফ্রেড এমবাপ্পে আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুনে জন্মেছিলেন। সে সূত্রে এমবাপ্পের কাছেও সুযোগ ছিল জাতীয় দল হিসেবে ক্যামেরুনকে বেছে নেওয়ার। তবে তেমনটা হয়নি। তেমনটা না হওয়াও হয়ত বেশ ভাল প্রভাব ফেলেছে এমবাপ্পের ক্যারিয়ারে।

এমবাপ্পে ১৩ বছর বয়সেই ফ্রান্স তথা ইউরোপের বাজারে আলোড়ন তোলেন নিজের সক্ষমতা দিয়ে। তবে তিনি আর স্থানীয় কোন ক্লাবের হয়ে সপ্তাহান্তে খেলতে নেমে সন্তুষ্ট ছিলেন না। যার ফলশ্রুতিতে, তাঁর বাবা বেছে নেন ফ্রেঞ্চ ক্লাব এএস মোনাকোর যুবদলকে। সেখানেই এমবাপ্পের নিজেকে ঝালিয়ে নেওয়া শুরু করেন। তবে মোনাকোর মূল দলে খেলার সুযোগটা তাঁর আর হয়ে উঠছিল না। এ নিয়ে তাঁর পরিবার আপত্তি জানায়। ফলাফলও পেয়ে যায়।

মাত্র ১৬ বছর ৩৪৭ দিনের মাথায় তিনি খেলতে নামেন মোনাকোর হয়ে। সেই সাথে বনে যান মোনাকোর ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় ও গোল স্কোরার। গোলটা অবশ্য তিনি করেছিলেন ১৭ বছর ৬২ দিনের মাথায়। সেখানে তিনি পেছনে ফেলেন ফ্রান্সের কিংবদন্তি খেলোয়াড় থিয়েরি অঁরিকে। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি এমবাপ্পেকে। রীতিমত ইউরোপের বাজারে হটকেক বনে যান এমবাপ্পে। ফলস্বরূপ ফ্রান্স জাতীয় দল থেকেও ডাক এসে যায় তাঁর।

যদিও তিনি চাইলে মাতৃ-সূত্রে আফ্রিকার আরেক দেশ আলজেরিয়ার হয়েও খেলতে পারতেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ফ্রান্সকে বেছে নেওয়াই ছিল উত্তম সিদ্ধান্ত। এমবাপ্পের পরিবার ঠিক সে সিদ্ধান্তটাই নেয়। ফলশ্রুতিতে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই কিলিয়ান এমবাপ্পে বনে যায় বিশ্বকাপ জয়ী এক তরুণ। আগ্রাসনের এক জলজ্যান্ত মূর্তি তিনি। চিতাবাঘের ন্যায় ক্ষিপ্র গতিতে তিনি ছুটে যাচ্ছেন ক্রমশ। এবারের বিশ্বকাপে আট গোল করে জিতেছেন গোল্ডেন বুট।

তাছাড়া ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়া থেকে এক গোল পিছিয়ে আছেন এমবাপ্পে। তিনি তাঁর অদম্য গতি নিয়ে ছুটে চলেছেন। খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না যদি তিনি জিতে নেন আরও একটি বিশ্বকাপ। অথবা ভেঙে ফেলেন সর্বাধিক বিশ্বকাপ গোলের রেকর্ডটি। সেটা করতে অবশ্য তাঁর খুব বেশি সমস্যা হবার কথা নয়। কেননা আর মাত্র পাঁচ খানা গোল প্রয়োজন তাঁর। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বিশ্বকাপেই তিনি সেটা করে ফেলতে পারেন।

তবে একটা বিষয় এমবাপ্পে এবং তাঁর পরিবারের সম্পর্কে বলতেই হয়। এখন অবধি ফ্রান্সের হয়ে জাতীয় দলের ফুটবল খেলার সিদ্ধান্তটা তাদের যথার্থই ছিল। কেননা, আফ্রিকান কোন দেশের হয়ে খেললে হয়ত তিনি নিজেকে এমন বিধ্বংসী রুপে মেলে ধরার সুযোগ পেতেন না। সে দিক থেকে নিজের পরিবারকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই পারেন এমবাপ্পে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link