পেলে নেই, ম্যারাডোনা নেই। কেমন অদ্ভুত লাগে না শুনতে? পেলে-ম্যারাডোনা ছাড়া আবার দুনিয়া হয় নাকি! তাঁদের কীর্তি, অর্জন, জীবন নিয়ে নতুন করে কিছু লেখার নেই। শুধু কিছু অনুভূতির কথা বলি। সম্ভবত, এই অনুভূতি আপনারও।
পেলে-ম্যারাডোনা কে? হাজার হাজার মাইল দূরের দেশের মানুষ। আমাদের দেশের নামটুকু হয়তো তারা শুনেছেন। ব্যস। ওইটুকু। তবু আমাদের কাছে তারা আত্মার আত্মীয়। কিংবা আরও বেশি কিছু। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। আমাদের যাপিত জীবনের সঙ্গী।
আমাদের প্রজন্ম, সেই ছেলেবেলায়, যখন ডিফেন্ডার মানে আমাদের কাছে ‘বেগি’, গোলকিপার ছিলেন ‘গোলকি’, পেনাল্টি তখনও ‘প্লান্টিক’, আর টাইব্রেকার নিশ্চিত ভাবেই ‘ট্রাইবেকার’, যখন ফুটবল মানে আমাদের কাছে স্রেফ লাথি মারা, কখনও জাম্বুরা, কখনও চর্মগোলকে, ফুটবল দুনিয়ার খবর রাখা বা বোঝার প্রশ্নই আসে না, তখন থেকেই পেলে-মারাদোনার সঙ্গে আমাদের পরিচয়।
যখন আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল ম্যাচ হলে চারপাশে দেখতাম তুমুল উত্তেজনা, রাস্তাঘাটে লোকজন কমে যেত, খেলার পরে মিছিলে আবাহনী বা মোহামেডানের নামে স্লোগান ধরতেন বড় ভাইরা, যখন মুন্না-সাব্বির-আসলামদের নাম টুকটাক শুনতে শুরু করেছি, তখনও আমরা পেলে-ম্যারাডোনার নাম জানতাম।
মারাদোনাকে চিনতাম শুনে শুনে। আর কিছু পোস্টার দেখে। ১৯৯০ বিশ্বকাপের পরের কিছু পোস্টার। জার্মানির ফুটবলাররা মারাদোনাকে ফাউল করছেন, সেই পোস্টারে লেখা, ‘ওরা আমাকে এত মারে কেন?’ আরেকটি পোস্টার, রেফারির বাঁশির সামনে প্রায় কান্নাভেজা চোখে ম্যারাডোনা, যেখানে লেখা, ‘রেফারি আমাদের জিততে দিল না’ – বাংলাদেশের মফস্বল বা গ্রামেও তুমুল বাজার পেয়েছিল সেই পোস্টারগুলি। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পোস্টারগুলি দেখতাম। কেনার পয়সা ছিল না (টাকা জমিয়ে প্রথম পোস্টার কিনেছিলাম ১৯৯৪ বিশ্বকাপের ফাইনালের আগে, রবের্তো বাজ্জোর, ১০ টাকায়)।
পেলের সঙ্গে পরিচয় আমাদের প্রজন্মের সবার পরিচয় এক ভাবেই। পাঠ্য বইয়ে ( ক্লাস ফোর নাকি ফাইভে?) ‘কালোমানিক পেলে’ নামের অমর গল্পে। তখন আমাদের রূপকথা পড়ার (আর শোনার) বয়স। বস্তির ছেলে, দারিদ্রপীড়িত পরিবারে বাড়তি দুটি পয়সার জন্য দোকানে কাজ করে, মোজার ভেতর কাগজ ঢুকিয়ে বল বানিয়ে খেলে, বস্তির পথে পথে খালি পেয়ে খেলে বিশ্বসেরা হয়ে ওঠা… ওসব বাস্তব মনে হত না। রূপকথার গল্পই ছিল যেন।
১৯৯৪ বিশ্বকাপে গ্রীসের বিপক্ষে মারাদোনার দুর্দান্ত সেই গোল আর বাঁধন হারা দৌড়ে ক্যামেরার সামনে ছুটে এসে খ্যাপাটে সেই ‘হা’, দেখেছিলাম টিভিতে। বয়স তখনও অনেক কম, তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে দেখেছি, তবু চোখে ভাসে এখনও। ক’দিন পর টিভির ইংলিশ নিউজে ম্যারাডোনাকে দেখায়। ইংলিশ খবর বুঝি না। চারপাশে সবার বিস্ময় দেখি, মারাদোনা নিষিদ্ধ। সবার কাছে শুনি, ষড়যন্ত্র করে তাকে বাদ দিয়েছে। বিশ্বাস করি। ছোট্ট বুকে হাহাকার জাগে।
ক্রমে আমরা বেড়ে উঠেছি। আস্তে আস্তে ফুটবল বুঝতে শিখেছি। পেলে-ম্যারাডোনার ওজন বুঝেছি। তারা তখন খেলেন না। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে দোলা দেন। নিত্য। প্রবলভাবে। আমরা তাদেরকে ধারণ করতে থাকি। একটু একটু করে। আরও বেশি করে।
আমরা তর্ক করি। তুলনা করি। ঘাটাঘাটি করি। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও পোক্ত হয়। ফিফা একজনকে শতাব্দী সেরা ঘোষণা করেন। আরেকজন বিপুল ভোটে সবচেয়ে জনতার সেরা হন। একজন মাঠের বাইরেও খ্যাপাটে। কোনো কিছু তোয়াক্কা করেন না। নিজের নিয়মে জীবন চালান। আরেকজন অনেক গোছানো। ইউনেস্কোর দূত হন। সম্মানসূচক নাইটহুড পান। দেশের ক্রীড়ামন্ত্রী হয়ে দুর্নীতির সঙ্গে লড়াই করেন। পদত্যাগও করেন। অনেক পরিশীলিত জীবন। তিনিও আবার নানা বেফাঁস মন্তব্য করেন। আকারে-ইঙ্গিতে তারা পরস্পরকে খোঁচাও দেন। আমরা সেসব নিয়ে কথা বলি। ভাবি। লড়াই করি। বুঁদ থাকি।
এখানেই তারা আসলে ছাড়িয়ে যান প্রজন্মের সীমানা। ফুটবল স্কিল, কীর্তি, অর্জন, এসব আসলে একটি অংশ মাত্র। তারা আমাদের জীবনের অংশ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ডুবে থাকে তাদের রোশনাইয়ে। সেই আলোয় কখনও চোখ ধাঁধিয়ে যায়, কখনও বিরক্ত লাগে, প্রায়ই বিস্ময় জাগে। কিন্তু আলোটা থাকেই। আমাদের ভেতরে-বাইরে, আমাদের জীবনে।
আপনি খেলা বা ফুটবল ভালোবাসুন আর না বাসুন, কম অনুসরণ করুন বা বেশি, আপনার বয়স এখন ২০ হোক বা ৪০, ৬০ কিংবা ৮০… আপনি জানেন, পেলে-মারাদোনা আছেন। আপনার-আমার, আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। ব্যস, তাঁরা আছেন।
এখন আর এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে তাদের শ্বাস মিশছে না আপনার সঙ্গে। নতুন কিছু করে খবরের শিরোনাম হচ্ছেন না, কোনো বাহাস চলছে না দুজনের, উদ্ভট কোনো প্রেডিকশন বা মন্তব্য করছেন না কেউ। এই তো! কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, তারা কি নেই? আরে, পেলে-ম্যারাডোনা ছাড়া দুনিয়া হয় নাকি!
আমরা যেমন জানি, সামনের অগুনতি প্রজন্মও জানবে… পেলে-ম্যারাডোনা আছেন। সঙ্গী হয়ে। গল্প হয়ে। সত্যি হয়ে। জীবন হয়ে।
– ফেসবুক থেকে