ফুটবল ইতিহাসের প্রথম এবং একমাত্র ফুটবলার হিসেবে তিনবার বিশ্বকাপ জিতেছেন পেলে। ৮২ বছর বয়সে গোটা ফুটবল বিশ্বকে কাঁদিয়ে পরলোকগমণ করেন কালো মানিক খ্যাত এই ফুটবল তারকা। তাঁর রেকর্ড কেউ স্পর্শ করতে না পারলেও জীবদ্দশায় ফরাসি তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পেকে স্নেহ করতেন পেলে। তাঁর ধারণা এমবাপ্পেই পারবেন তাঁর তিন বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড স্পর্শ করতে।
২০১৭ সালে পেশাদার ফুটবলে অভিষেকের পর থেকেই পেলের প্রশংসা পেয়েছেন এমবাপ্পে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে আইডল মেনে বড় হওয়া এমবাপ্পে বর্তমানে পিএসজিতে লিওনেল মেসির সতীর্থ। ক্যারিয়ারের শুরুটা মোনাকোতে হলেও রেকর্ড ট্রান্সফার ফি’তে যোগ দেন ফরাসি জায়ান্ট পিএসজিতে। ক্যারিয়ারের পুরোটা সময়েই রিয়াল মাদ্রিদে যাবার গুঞ্জন থাকলেও এখনো আছেন প্যারিসের ক্লাবটিতে।
ক্লাবের পাশাপাশি জাতীয় দলের জার্সিতেও সমান সফল এমবাপ্পে। চার বছর আগের রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করে কিশোর বয়সেই জাতীয় দলকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। নিজে জিতেছিলেন সেরা তরুণ ফুটবলারের খেতাব। চার বছর বাদে কাতার বিশ্বকাপেও সমান উজ্জ্বল এমবাপ্পে। যদিও ফাইনালে হ্যাটট্রিক করেও শিরোপার খুব কাছে থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। টাইব্রেকারে এমিলিয়ানো মার্টিনেজ নামের এক প্রাচীরে বাঁধা পেয়ে ফিরতে হয়েছে ফ্রান্সকে। এমবাপ্পের জেতা হয়নি টানা দুই বিশ্বকাপ ট্রফি।
যদিও দুটো বিশ্বকাপেই ফ্রান্সের সেরা তারকা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপেও আট গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার খেতাব গোল্ডেন বুট জিতেছেন তিনি। বয়স সবে ২৪, এর মাঝেই বিশ্বকাপে ১২ গোল হয়ে গেছে এমবাপ্পের। ফর্মটা ধরে রাখতে পারলে আগামী বিশ্বকাপেই মিরোস্লাভ ক্লোসার ১৬ গোলের রেকর্ড নিজের করে নেবেন এমবাপ্পে সেটা বলাই বাহুল্য।
নিজের পারফরম্যান্স দিয়েই পেলের মন জয় করে নিয়েছিলেন ফরাসি এই তরুণ। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই কিংবদন্তির সাথে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ এক সম্পর্ক। পেলের স্বাস্থ্য যখন অবনতির দিকে, সেই প্রথম থেকে তাঁকে সাহস জুগিয়েছেন এমবাপ্পে। তাছাড়া মাঠের খেলাতেও তাঁদের দুজনের কি দারুণ মিল! ছয় যুগ আগে পেলে যেসব কীর্তি গড়ে গেছেন তাঁর কিছুটা হলেও যেন ফিরে পাচ্ছেন এমবাপ্পের খেলায়। দুজনেই টিনেজার বয়সে বিশ্বকাপ জিতেছেন, ফাইনালে গোল পেয়েছেন।
পেলের পর দ্বিতীয় টিনেজার হিসেবে বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে গোল করেছেন এমবাপ্পে। ক্যারিয়ারের শুরুতেই গারিঞ্চা, সান্তোসদের নিয়ে গড়া দারুণ এক দলের অংশ ছিলেন পেলে। তেমনি এমবাপ্পেও ফ্রান্স দলে পেয়েছেন দারুণ এক প্রজন্ম। গ্রিজম্যান, পগবা, জিরুডদের নিয়ে গড়া ফ্রান্স দল ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দলের যোগ্য দাবিদার।
তবে সেই ব্রাজিল দলের প্রাণভোমরা যেমন ছিলেন পেলে, তেমনি এই ফ্রান্সের মূল চালিকাশক্তি এমবাপ্পে। কাছাকাছি বয়সেই দুজন আলো ছড়িয়েছেন বিশ্বকাপের মঞ্চে। ১৯৫৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে সুইডেনের বিপক্ষে জোড়া গোল করেছিলেন পেলে। সেদিন তাঁর নৈপুণ্যে ভর করে স্বাগতিকদের হারিয়ে প্রথম বারের মত বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত।
অন্যদিকে, ২০১৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করে দলকে জেতালেও ২০২২ বিশ্বকাপ ফাইনালে এমবাপ্পেকে দুর্ভাগাই বলতে হবে। নইলে ফাইনালে হ্যাটট্রিক করেও কেন পরাজিত দলে থাকতে হবে তাঁকে। তবে এমবাপ্পের বয়স মোটে ২৪। বড় কোনো ইনজুরিতে না পড়লে আরো তিনটি বিশ্বকাপে মাঠে নামার কথা তাঁর। ফ্রান্সের সোনালি প্রজন্ম আর এমবাপ্পের উড়ন্ত ফর্ম – দুয়ে মিলে আগামী বিশ্বকাপগুলোতে ফ্রান্সই ফেবারিট সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সব মিলিয়ে এমবাপ্পের সামনে সুযোগ পেলের তিন বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড ছাপিয়ে যাবার। সেটা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হলেও অন্তত আরো দুটো বিশ্বকাপ জয়ের যোগ্য দাবিদার তিনি। কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয় মোটেই। পেলের পর তিনটি বিশ্বকাপ জেতার দৌড়ে এমবাপ্পে তাই টিকে আছেন প্রবলভাবেই। আর তিনি সেটা করতে পারলে ওপারে থেকে নিশ্চিতভাবেই খুশি হবেন পেলে। মুচকি হেসে উঠবেন অসমবয়সী বন্ধুর এগিয়ে যাওয়ায়।