গঞ্জালো হিগুয়েন, আর্জেন্টিনার অনন্ত আক্ষেপ

২০১৫ সালের কোপা আমেরিকার শিরোপার জন্য শেষ লড়াইয়ে সেদিন মাঠে নেমেছিল আর্জেন্টিনা। গোলশূন্য ম্যাচ যখন প্রায় অন্তিম মুহূর্তে পৌঁছে গিয়েছিল তখনই দারুণ একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছিল আর্জেন্টিনা; শুধু প্রয়োজন ছিল একটি ফিনিশিং টাচের। কিন্তু ডি-বক্সে থাকা গঞ্জালো হিগুয়েন পা ছোঁয়ানোর কাজটাও ঠিকভাবে না করতে পারায় গোলটা করা হয়নি। শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে ম্যাচ হেরে যায় লিওনেল মেসির দল।

ঠিক এক বছর আগের কথা; বিশ্বকাপ ফাইনালের গল্প। জার্মান ডিফেন্ডার টনি ক্রুসের ভুলে ফাঁকায় বল পেয়ে যান গঞ্জালো হিগুয়েন কিন্তু ম্যানুয়েল নয়্যারকে একা পেয়েও সে সময় গোল দিতে পারেননি তিনি।

হিরো হওয়ার এমন সুবর্ণ সুযোগ সেদিন হেলায় হারিয়েছিলেন এই স্ট্রাইকার। ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকার ফাইনালেও দৃশ্যপট একই; টাইব্রেকারে মিস করে দলকে হতাশা উপহার দিয়েছিলেন সাবেক জুভেন্টাস তারকা।

হাইভোল্টেজ ফাইনাল, সহজ সুযোগ হাতছাড়া – গঞ্জালো হিগুয়েনের ক্যারিয়ারকে এই দুইটি শব্দেই আটকে দিয়েছেন আর্জেন্টিনার ভক্ত-সমর্থকেরা। তাই তো তিনটি ফাইনাল হারের সব ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তাঁর উপর। সম্ভবত দলটির ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত ফুটবলারদের তালিকায় উপরের দিকেই থাকবেন হিগুয়েন।

মুদ্রার অন্য পিঠও আছে অবশ্য; ২০১০ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে আর্জেন্টিনার তখন শোচনীয় অবস্থা। বলিভিয়ার কাছে ৬-১ গোলে বিধ্বস্ত হওয়ার পর হেরেছে টানা তিন ম্যাচ; ফলে বিশ্বকাপের মূল পর্বে জায়গা পাওয়াই ছিল শঙ্কার মুখে।

ডু অর ডাই ম্যাচে তৎকালীন কোচ ডিয়েগো ম্যারাডোনা আস্থা রেখেছিলেন তরুণ গঞ্জালো হিগুয়েনের উপর। পেরুর বিপক্ষে মান বাঁচানোর সেই ম্যাচটিই আবার ছিল তাঁর অভিষেক ম্যাচ; জাতীয় দলের জার্সি গায়ে সেদিনই প্রথম গোল দিয়ে দলকে লিড এনে দিয়েছিলেন তিনি।

তবে সেদিন সব আলো কেড়ে নিয়েছেন ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজার একটু আগে গোল করা মার্টিন পার্লেমো। তাই তো অভিষেক ম্যাচে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেও আলোচনার বাইরে ছিলেন গঞ্জালো হিগুয়েন। আসলে সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ তারকার ক্যারিয়ার কেটেছে এভাবেই; সফলতার গুণগান যতটুকু হয়েছে তার চেয়ে বহুগুণে বেশি পেয়েছেন নিন্দে আর কটু বাক্য।

১৯৮৭ সালের ১০ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করা গঞ্জালো হিগুয়েন আর্জেন্টিনার অন্য সব শিশুর মতই ফুটবলের বিদ্যে আগে শিখেছিলেন। এরপর ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ডানা মেলেছিল রিভার প্লেটের ক্লাবের সঙ্গে পেশাদার চুক্তি করার পর থেকে। ১৯ বছর বয়সে রিভার প্লেটে যোগ দেয়ার পর পরই ইউরোপীয় দলগুলোর নজরে পড়েন তিনি।

তাই তো পরের বছরে ১২ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে আর্জেন্টাইন ফুটবলারকে নিজেদের ডেরায় নিয়ে আসে রিয়াল মাদ্রিদ। মাদ্রিদের রাজকীয় ক্লাবটির হয়ে দীর্ঘ ছয় বছর খেলেছিলেন তিনি। এসময় ১২১ গোলের পাশাপাশি ৫৬টি অ্যাসিস্ট করেছিলেন এই স্ট্রাইকার। লস ব্ল্যাঙ্কোসদের হয়ে তিনটি লিগ শিরোপা জিতেছিলেন তিনি।

২০১৩/১৪ মৌসুমে ডিয়েগো ম্যারাডোনার পরামর্শেই রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে এসএসসি নাপোলিতে যোগ দেন গঞ্জালো হিগুয়েন। দলটির হয়ে দুর্দান্ত সময় কাটালেও বড় কোন শিরোপা জেতা হয়নি এই তারকার।

দীর্ঘ এক ক্যারিয়ারে জুভেন্টাস, এসি মিলান, চেলসির মত পরাশক্তিদের স্ট্রাইকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন গঞ্জালো হিগুয়েন। তুরিনের বুড়িদের হয়েই খেলেছেন তিন বছর। ইউরোপের পাঠ চুকানোর পর ক্যারিয়ারের শেষ দিকে ইন্টার মিয়ামির জার্সি গায়ে উঠেছিল তাঁর। সব মিলিয়ে নিজের ক্লাব ক্যারিয়ারে ৭১০ ম্যাচ খেলে ৩৩৫ গোল করেছেন তিনি। সেই থেকে সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন আরো ১১৩টি গোল।

আর্জেন্টিনার হয়ে তিনটি ফাইনালের হতশ্রীকর পারফরম্যান্স বাদ দিলে গঞ্জালো হিগুয়েন নি:সন্দেহে ছিলেন তাঁর সময়ের সেরা নাম্বার নাইন। ফিনিশিং আর গোলক্ষুধা তাঁকে করে তুলেছিল অনন্য; পাশাপাশি ছিল ড্রিবলিং করার সামর্থ্য আর দুর্দান্ত গতি। অন্য স্ট্রাইকারদের মত স্বার্থপর নন, এই আর্জেন্টাইন ছিলেন ‘পারফেক্ট টিমম্যান’।

ক্লাব ক্যারিয়ারের দারুণ মুহুর্ত কিংবা ২০১০ বিশ্বকাপের আগে মান বাঁচানো সেই পারফরম্যান্সের জন্য নয় আর্জেন্টিনার গঞ্জালো হিগুয়েনকে ফুটবল বিশ্ব মনে রাখবে টানা তিনটি ফাইনালে ম্যাচে গোল মিস করার জন্য। ২০১৪ বিশ্বকাপে কিংবা মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের শেষ লড়াইয়ে গোল করে যেখানে জাতীয় নায়ক হতে পারতেন হিগুয়েন, সেখানে খলনায়ক হয়েই থেমে গেলেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link