তার নাম না শোনাটা অন্যায় নয়; পাপ।
আপনি লিভারপুল সমর্থক, এমনকি ইংলিশ লিগের নিয়মিত দর্শক হলেও এই মানুষটার সম্পর্কে না জানাটা পাপের পর্যায়ে পড়ে। তিনি ইংলিশ ফুটবলের এক কিংবদন্তী, ওয়েলসের ফুটবল নায়ক এবং লিভারপুলের সর্বকালের সর্বোচ্চ স্কোরার।
হ্যাঁ, ইয়ান জেমস রাশ। ভক্তরা বলে ইয়ান রাশ; দ্য ঘোস্ট।
মার্সেসাইডে শৈশবে তার প্রিয় ক্লাব ছিল নগরপ্রতিদ্বন্ধী এভারটন। এভারটনের মাঠ গুডিসন পার্কে গিয়ে অনেক বারই উচ্চ ডেসিবলের সঙ্গী হয়েছিলেন ব্লুজদের! অথচ মাত্র আঠারো বছর বয়সেই লিজেন্ডারি কোচ পেইসলি ততকালীন ট্রান্সফার ফি রেকর্ড তিন লাখ ইউরো খরচ করে চেস্টার সিটির থেকে কিনে লিভারপুলেই ভেড়ান তাঁকে।
১৩ ডিসেম্বর ১৯৮০, লিগ ম্যাচে লিভারপুলের হয়ে অভিষেক হয়। স্ট্রাইকার কেনি ডাগলিশের ইনজুরি শুরুর দিকে দলে জায়গা হলেও খুব বেশি ম্যাচ খেলতে পারেনি; ফলে গোলেরও দেখা হয়নি। প্রথম গোলের জন্য অপেক্ষা করতে হয় দ্বিতীয় সিজন অবধি। ঠিক পরের মৌসুমে ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সালে ইউরোপিয়ান কাপে গোলের খেরোখাতা আরম্ভ করেন।
সেই থেকে শুরু; তারপর আর পিছনেই ফিরে তাকাতে হয়নি! দ্বিতীয় মৌসুমেই ৪৯ ম্যাচে সবমিলিয়ে ৩০ গোল করে হয়ে যান দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা। শৈশবেই যিনি স্বপ্ন দেখতেন ব্লুজদের হয়ে একদিন পুরো গুডিসন পার্ক মাতাবেন; সেই তিনিই হয়ে গেলেন মার্সেসাইড ডার্বির সর্বোচ্চ গোলদাতা। না প্রিয় ক্লাব এভারটনের হয়েই নয়, হয়েছেন রাইভাল লিভারপুলের হয়ে।
ওয়েলস ও লিভারপুল ক্লাব ইতিহাসে সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা আশির দশকে ইউরোপ মাতানো ‘দ্য সুপার সাইক্লোন লিভারপুল’ খ্যাত দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ ইয়ান জেমস রাশ।
সেনাপতি কেনি ডাগলিশ আর রাজা রবার্ট পেইসলির নেতৃত্ব লিভারপুল যে সাম্রাজ্যের জয় করেছিলেন রাশ ছিলেন তার একজন প্রকৃত তীরন্দাজ। অলরেডদের সাম্রাজ্যে উথানের অনেকগুলো মহানায়কদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ড্রিবলিং এবং প্রচন্ড শারীরিক ক্ষমতা- এই দুইয়ের পার্ফেক্ট সমন্বয় ইতিহাসে যে’কজন স্ট্রাইকারের মধ্যে দেখা গেছে রাশে তাদের অন্যতম। অত্যন্ত সুযোগসন্ধানী, কৌশলী এবং গতিশীল এই স্ট্রাইকারের গোলের সাথে নিবিড় সম্পর্ক হার মানাতে বাধ্য যেকোন প্রেমকাহিনীকেও।
গোলের সাথে তার এই সখ্যতাই বানিয়েছে লিভারপুলের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা ও ইপিএল ইতিহাসে অন্যতম সেরা স্ট্রাইকারদের একজন। গোলের সামনে রাশ ছিলেন একজন সত্যিকার শিকারী ঈগলের মত। তার ড্রিবলিং, ভিশন, পাসিং এক্যুরেসি ছিল তার সময়কার অন্য সব স্ট্রাইকারদের স্বপ্নের মত। উচ্চতা বেশি হওয়ায় হেডেও ছিলেন সমান পারদর্শী। তার সবচেয়ে বড় গুন ছিল, ফুটবলটাকে তিনি এতটা ভালো বুঝতেন- মাঠে প্রতিপক্ষ বুঝে উঠার আগেই খুব দ্রুত স্বীদ্ধান্ত নিতে পারতেন।
অসাধারণ সব ড্রিবলিঙে প্রতিপক্ষের প্লেয়ার পিছনে ছিটকে ফেলে দিতেন বলে ইংলিশ মিডিয়া তার নাম দিয়েছিল ‘দ্য ঘোস্ট’।
রাশ যখন লিভারপুলে; অলরেডরা তখন ইউরোপের জায়ান্ট দলগুলোর একটি। মাত্র ৫ বছর আগেই জার্ড মুলার ও কাইজারদের সর্বজয়ী বায়ার্ন মিউনিখের ইউরোপীয় ডমিনেশন ভেঙ্গে ব্যাক টু ব্যাক চ্যাম্পিয়নস লীগ জেতে অলরেডরা। ডিফেন্ডিং লিগ চ্যাম্পিয়ন ও লিগ কাপজয়ী লিভারপুল তৃতীয়বার ইউরোপসেরা হলেও রাশের ডেব্যু সিজন সপ্তম হয়ে লিগ হাতছাড়া করে এস্টন ভিলার কাছে। যদিও এই মৌসুমে তরুণ রাশ সবমিলিয়ে পুরো নব্বই মিনিট খেলতে পারেনি একটি ম্যাচ। সময়ের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার কেনি ডাগলিশ ও ডেভিড জনসনের কাছে জায়গা না পেয়ে সিজনের বেশিরভাগ ম্যাচই সাব হিসেবে খেলেন।
দ্বিতীয় মৌসুমের শুরুতে ভাগ্য খোলে রাশের। স্ট্রাইকার ডেভিড জনসনের ইঞ্জুরিতে ইউরোপিয় কাপের গ্রুপ স্টেজে ঘরের মাঠ অ্যানফিল্ডে ওলান পালোসেওরার বিপক্ষে ৬৭ টি মিনিটে গোল করে অলরেডদের হয়ে গোলের খাতা আরম্ভ করেন। তারপর টানা চার ম্যাচ সাব হিসেবে নেমে আরও পাঁচ গোল করে কোচ বব পেইসলিকে নিজের উপস্থিতির জানান দেন।
পেইসলি পরের ম্যাচেই ডাগলিশের পরিবর্তে মূল একাদশেই নামিয়ে দেন তাকে। বেস্ট এলিভেনে জায়গা পেয়ে প্রথম ম্যাচেই জোড়া গোল করে কোচের আস্থার দারুণ প্রতিদান দেন। ক্রিসমাসেই নিজের স্বপ্নের মার্সেসাইড ডার্বিতে প্রথম গোল করেন। লিভারপুল ম্যাচটি জিতে ৩-১ গোলে। ক্রিসমাসের পরে জানুয়ারী মাসে লিগ কাপে নেট কাউন্টি দলের বিপক্ষে অলরেডদের হয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম হ্যাটট্রিক করেন। লিগ কাপের পরের দুই ম্যাচও টানা গোল করেন। ফাইনালে তার একমাত্র গোলে টটেনহ্যাম হটস্পার্সকে হারিয়ে লিগ কাপ জিতে লিভারপুল। লিগ কাপে রাশ গোল করেন সর্বোচ্চ ৮টি।
লিগ কাপের অসাধারণ পারফরম্যান্স অব্যাহত রাখেন লিগ ম্যাচেও। ২৪ ম্যাচে ১৭ গোল করে এস্টন ভিলা থেকে লিগ টাইটেলও পুনরুদ্ধার করেন। এই মৌসুমে ৪৯ ম্যাচে ৩০ গোল করে জিতেন পিএফএ ইয়ং প্লেয়ার অব দ্যা ইয়ারের পুরস্কার।
পরের মৌসুমে ইয়ান রাশ ও কেনি ডাগলিশের দারুণ পার্টনারশিপ ডাবল জিতে লিভারপুল; রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে তৃতীয়বার ইউরোপসেরা হয়। এই সিজনে ফার্স্ট ডিভিশন লিগে রাশের সর্বোচ্চ ২৪ গোলে রানার্স-আপ ওয়াটফোর্ট থেকে পরিস্কার ১১ পয়েন্ট ব্যবধানে লিগ টাইটেল জিতে। ক্যারিয়ারের সেরা ম্যাচটিও খেলেন এই মৌসুমেই।
৬ই নভেম্বর ১৯৮২, মার্সেসাইড ডার্বিতে এভারটনকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দেয় অলরেড। ম্যাচে একাই ৪ গোল করে ডার্বিতে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়েন ইয়ান রাশ। এক রাশের কাছেই ব্লুজদের এই অসহায় আত্মসমর্পণে বিশ্বব্যাপি অলরেড ‘Poor scouser tommy’ গানে শ্লোক গেয়ে সেলিব্রেট করে!!
লিভারপুলের হয়ে তৃতীয় মৌসুমটি ছিল ইয়ান রাশের ক্যারিয়ারে স্বপ্নের বছর। এই মৌসুমেই রাশ যা করেছেন আগে কোন অলরেড প্লেয়ার তা করতে পারেনি! ৬৫ ম্যাচে গোল করেন ৪৭টি। যা ছিল ইউরোপের যেকোন ক্লাবের প্লেয়ারের চেয়ে সর্বোচ্চ। ফলশ্রুতিতে, প্রথমবার ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুটও জেতেন! মাত্র তিন পয়েন্ট ব্যবধানেই সাউদাম্পটনকে হারিয়ে সেবার লিগ জিতে নেয় লিভারপুল। এএস রোমাকে ট্রাইবেকারে হারিয়ে চতুর্থবার ইউরোপীয়ান কাপ এবং রাইভাল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারিয়ে মৌসুমের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ট্রফি জিতে নেয়। মৌসুমজুড়ে অসাধারণ পারফরম্যান্স করে দ্বিতীয়বার প্রিমিয়ার লিগের সেরা প্লেয়ার নির্বাচিত হন।
পরের মৌসুম মোটেও ভালো যায়নি ইয়ান রাশদের। গেল দশ বছরে এবারই প্রথম ট্রফিলেস সিজন কাটাতে হয় অলরেডদের। যদিও এবারও ইউরোপসেরা হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ ছিল- কিন্তু ৫মবারের মতো ইউরোপীয়ান কাপের ফাইনালে উঠলেও ইতালিয়ান জায়ান্ট তুরিনো বুড়িদের কাছে হেরে রানার্স আপেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ম্যাচেই ইতিহাসের মর্মান্তিক ‘Heysel Stadium Disaster’ ট্রাজেডিতে ৩৯ জন জুভেন্টাস ফ্যানের মৃত্যু হয়; ব্রিটিশ ক্লাবগুলোর উপর নেমে আসে এক কালো অধ্যায়। কয়েক বছরের জন্য সব ধরনের ইউরোপীয়ান কম্পিটিশনে নির্বাসিত হয় ইংল্যান্ডের ক্লাবগুলো। এক বছর বাড়তি ব্যান থাকার ফলে লিভারপুলও ১৯৮৫-৮৬ উয়েফা কাপ খেলার সুযোগ হাতছাড়া করে।
তার উপর মরার উপর খাড়ার ঘা হয় কোচ জো ফাগনাসের অসময়ের পদত্যাগ! এসময় প্রচন্ড বাজে সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় মার্সেসাইডের সবাইর প্রিয় ক্লাবটির। এবার দলের প্লেয়ার ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ক্লাবের রক্ষাকর্তা হিসেবে হাজির হন কিং কেনি ডাগলিশ। ইউরোপীয়ান কম্পিটিশনে নিষিদ্ধ থাকায় ডাগলিশের অধীনে লিভারপুল বাড়তি নজর দেয় ঘরোয়া লীগে। যার ফলাফলও আসে হাতেনাতে- ইয়ান রাশের সর্বোচ্চ ২৮ ম্যাচে ২২ গোলের উপর ভর করে রাইভাল ম্যান ইউনাইটেডকে হারিয়ে আবারও লিগ টাইটেল জেতে। পরে ইতিহাসের প্রথম অল মার্সেসাইড ডার্বির ফাইনালে রাশের জোড়া গোলে গ্যারি লিনেকারের এভারটনকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবার ঘরোয়া ডাবল জিতে নেয় লিভারপুল। ৫ ম্যাচে ৬ গোল করে টুর্নামেন্টে সেরা প্লেয়ার নির্বাচিত হন ইয়ান রাশ। মৌসুমে সবমিলিয়ে লিভারপুলের হয়ে ৪৪ ম্যাচে করেন সর্বোচ্চ ৩৩ গোল।
লিভারপুলের হয়ে তার টানা অসাধারণ পারফরম্যান্স মুগ্ধ করে ইউরোপের অন্যসব জায়ান্ট দলগুলোকেও। রিয়াল মাদ্রিদ, নাপোলি, জুভেন্টাস ও এসি মিলানের মত দলগুলো বড় অংকের টাকায় তাকে দলে ভেড়াতে চায়। ইতালিয়ান ক্লাব নাপোলি একবার রাশকে দলেও কনফার্মও করে ফেলছিল প্রায়; যদিও শেষে চেয়ারম্যান জন স্মিথের মধ্যস্থতায় তা ভেস্তে যায়! রাশকে না পেয়ে নাপোলি বার্সেলোনা থেকে সাইন করিয়ে নেয় দ্যা গ্রেট দিয়াগো আরমানো ম্যারাডোনাকে। পরে রাশ নিজে এই ডিল সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘নাপোলি আমাকে রেকর্ড এক মিলিয়ন অফার করেছিল,ট্রান্সফার ডেডলাইনে শেষ মুহুর্তে আমি তাদের সাথে কথাও বলি। কিন্তু, জন স্মিথ (চেয়ারম্যান) তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে।’
অবশ্য এভাবে রাশকে বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি লিভারপুল। হেইসেল ট্রাজিডিতে ইউরোপীয়ান টুর্নামেন্ট থেকে ব্যান থাকার কারণে ক্লাব অর্থনৈতিক সংকটে মধ্যে পড়ে। লিভারপুল বাধ্য হয়েই দলের সেরা প্লেয়ার ছাড়া প্রস্তুতি নেয়। ১৯৮৬ সালে জুভেন্টাস রেকর্ড ৩.২ মিলিয়নে কিংবদন্তী মিশেল প্লাতিনির রিপ্লেসে দলে ভেড়ায় রাশকে। প্লাতিনি জুভেন্টাসের হয়ে আরও এক মৌসুম খেলতে চাইলে রাশ লিভারপুলে এক মৌসুম লোনে খেলেন। অনেকে ভেবে নিয়েছিল লোনে খেলায় হয়তো এই মৌসুমে নিজের সেরা খেলা খেলবে না রাশ। কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে এই মৌসুমেও ২১ ম্যাচে আরও ২১ গোল করেন।
লিগ কাপের ফাইনালে নিজে গোল করলেও আর্সেনালের বিপক্ষে ম্যাচটি হেরে ট্রফি হাতছাড়া করে লিভারপুল। এবং সেই সাথে অবিশ্বাস্য টানা ১৪৫ ম্যাচ রাশ গোল করা ম্যাচে লিভারপুলের অনবিটেন থাকার রেকর্ডটিও ব্রেক হয়ে যায়। শেষ আট ম্যাচে আরও ছয় গোল করে অবশেষে লিভারপুল ছেড়ে পাড়ি জমায় ইতালিতে।
ফ্রান্স মায়েস্ত্রো প্লাতিনির বিদায়ে ওল্ড লেডিরা ইয়ান রাশকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন বোনে। তাই ইতালিতে এসে মূল একাদশেও জায়গা পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি রাশের। কিন্তু, জুভেন্টাসের জার্সি গায়ে আলো ছড়াতে ব্যর্থ হোন; অসুস্থতা, ইতালির ন্যাচারাল হার্ড ডিফেন্সিভ প্লেয়িং স্টাইলে ঘনঘন ইনজুরির জন্য ওল্ড লেডিদের হয়ে নিজের সেরা খেলাটা খেলতে পারেনি। পুরো সিজনে ২৯ ম্যাচে মাত্র আটবার জালের দেখা পান, যা কোন ভাবেই সেই সময়ের রাশের স্ট্যাটের সাথে যাচ্ছিল না।
তাই মৌসুম শেষেই জুভেন্টাসও রাশের রিপ্লেস খোঁজা শুরু করেন। লিভারপুল তখন ইঞ্জুর অ্যালান হ্যানসনের রিপ্লেস খুজছিল। তার জন্য মিডলেসব্রুর তুখর ফর্মে থাকা গ্যারি প্যালিস্তারকে সাইন করানো প্রস্তুতিও নিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু, কেনি ডাগলিশের পরামর্শে সবাইকে চমকে দিয়ে ম্যানেজমেন্ট হঠাৎ রাশকে অ্যানফিল্ডে ফিরেয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। অবশেষে, ১৯৮৮ সালের ১৮ ই আগস্ট, জুভেন্টাসের মাত্র এক বছরের পাঠ চুকিয়ে সেই সময়ের ইংলিশ ক্লাবগুলোর রেকর্ড ২.৭ মিলিয়ন ট্রান্সফারে লিভারপুলে ব্যাক করেন।
ইয়ান রাশ একমাত্র ফুটবলার হিসাবে সেই সময়ে তিন তিনটি ট্রান্সফার রেকর্ড গড়েন। রাশের ফিরে আসা অলরেড সমর্থকদের মাঝে চরম উত্তেজনা বিরাজ করে। তাই উল্লাসিত লিভারপুল ফ্যানরা স্টোডিয়াম গাইতে থাকে, ‘রাশে ইজ ব্যাক, রাশে ইজ ব্যাক….’
লিভারপুলে ফিরে এসেই তাকে মারাত্মক কম্পিটিশন করতে হয় জোন অ্যালড্রিডজ ও পেটার বিয়ার্ডস্লির সাথে। অ্যালড্রিডজের ফর্ম ও প্লেয়িং স্টাইল সেইম থাকায় শুরুতে কিছু ম্যাচ বেঞ্চেও কাটাতে হয় রাশকে। তখনো লিভারপুলের জার্সিতে খেলছেন ৩৯ বছর বয়সী ডাগলিশ। রাশ জুভেন্টাস ছেড়ে এসে সেখানে তার কাটানো সময়গুলো নিয়ে একটি বইও লিখেন। বইয়ের নাম-মাই ইতালিয়ান ডাইরি। সেখানে ইতালিতে তার দুর্দশা ও খাপ খাওয়াতে না পারার ঘটনাও তুলে ধরেন।
অ্যানফিল্ডে ফিরে ধীরে ধীরে নিজের হারানো ফর্ম খুজে পান। এই বছর এফএ কাপের ফাইনালে নাটকীয় ম্যাচে রাশের শেষ মুহূর্তের গোলে এভারটনকে হারিয়ে শিরোপা জিতে লিভারপুল। নতুন মেয়াদে লিভারপুলের জার্সিতে খেলেন আরও আট বছর; এবং একটি লীগ টাইটেল, দুইটি এফএ কাপ, একটি লিগ কাপ ও একটি চ্যারিটি শিল্ড কাপসহ জিতেন আরও ৫টি শিরোপা। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে লিভারপুলের সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে রাশের; কিন্তু তার আগেই রাশ নিজে অফিশিয়ালি ফ্রি ট্রান্সফারে অ্যানফিল্ড ছাড়ার ঘোষণা দেন। একই বছর লিভারপুলে তার বর্নিল ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টেনে রাশ লিডস ইউনাইটেডে যোগদান করেন।
লিভারপুলের হয়ে দুই দফা প্রায় ১৬ বছরের ৫৯৩ ম্যাচে গোল করেন ক্লাব রেকর্ড ৩০০। অ্যাসিস্ট করেন আরও ৫৬ টি। ৫ টি লিগ টাইটেল, ৫ টি লিগ কাপ, ৩ টি এফএ কাপ, ৩ চ্যারিটি শিল্ড কাপ এবং দুইটি ইউরোপিয়ান কাপসহ জিতেন সর্বমোট ১৮টি শিরোপা। লিভারপুল ছেড়ে নিউক্যাসেল ইউনাইটেড, শেফিল্ড ইউনাইটেড ঘুরে সিডনি অলিম্পিকে এসে ৩৮ বছর বয়সে অবসর ঘোষণা করেন।
লিভারপুলে ডেব্যু হওয়ার আগে জাতীয় দল ওয়েলসে অভিষেক হয়ে যায় রাশের। ১৯৮০ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েলসের হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলেন। সেই থেকে ১৬টি বছর জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন। রাশের সময় ওয়েলস ইউরোপীয় বড় কোন টুর্নামেন্ট খেলতে পারেনি; কিন্তু যখনই সুযোগ পেয়েছেন নিজের প্রকৃর জাত চিনিয়েছেন। তাই এখনও ওয়েলস জাতীয় দলের সর্বকালের সর্বোচ্চ ২৮ গোল তাঁর দখলে।
১৯৯৬ সালে ক্লাবের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলার দু’মাস পর জাতীয় দলের হয়েও বর্নাট্য ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানেন। ২০০৪ সালে আবারও ফুটবলে ফিরে আসেন। এবার খেলোয়াড় নয়;নতুন ম্যানেজার হিসেবে। শৈশবের ক্লাব চেস্টার সিটির দায়িত্ব নেন। তবে প্লেয়ার হিসেবে যতটা উজ্জ্বল ছিলেন, ম্যানেজার হিসেবে তার ছিটেফোঁটাও ছিল না। অত্যন্ত জঘন্যভাবেই চেস্টারে সিজন শুরু করেন। চারদিকে তীব্র সমালোচনার তীর তার দিকে ধেয়ে আসতে থাকে। একের পর এক ক্লাবের বাজে ফলাফলে মৌসুম শেষে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন।
সম্ভবত ম্যানেজার হিসেবে চেস্টার সিটিতে তার চরম বাজে অভিজ্ঞতার কারণেই পরে আর ম্যানেজার হতে অনুৎসাহিত করেছে। যদিও এখনও ফুটবল সম্পর্কিত কাজেই বেশ সোচ্চার। বর্তমানে তাকে ইএসপিএন, স্কাই স্পোর্টস, স্কাই স্পোর্টস নিউজ এবং এলএফসি টিভিতে ফুটবল এনালাইসিস্ট হিসেবে দেখা যায়।
২০০৬ সালে ফুটবলে তার সাধারণ অবদান রাখার জন্য ‘English Football Hall Of Fame’ জায়গা পান। লিভারপুলের অফিশিয়াল ফ্যানদের ভোটে সর্বকালের সেরা একশো অলরেড প্লেয়ারদের ‘Who Shook The Kop’ পোলে রাশের অবস্থান ছিল তৃতীয়। ২০১৭ সালে বিখ্যাত কার্ডিফে অনুষ্ঠিত হওয়া উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের অ্যাম্বেসেডর ছিলেন তিনি।
জানি ফুটবল কেবল গোলের খেলা না! কিন্তু আপনি যদি গোলই দিতে না পারেন তাহলে ফুটবল কোন খেলার মধ্যেই পড়ে না। এখানে সকল শিল্প, কারুকার্য, ট্যাকটিক্স বৃথা হয় যদি আপনি গোলের দেখা না পান। তাই ফুটবলে এমন কিছু খেলোয়াড় এসেছে যারা প্রতিপক্ষের সামান্যতম ভুলও কাজে লাগিয়ে নিজেদের কিংবদন্তির কাতারে সামিল করেছেন। ইয়ান রাশ তাঁদের একজন।
তিনি ছিলেন খুব উঁচু জাত স্ট্রাইকার; গোল করাটাই যেন ছিল তার নেশা! তার অনিন্দ্য সুন্দর ড্রিবলিং, ডান পায়ের থেকে বল বাম পায়ে নিয়ে আসা – অত:পর কামানের গোলার মত তার প্রত্যেকটা সুপারহিউম্যান শর্ট ফুটবলপ্রেমীদের মন্ত্রমুগ্ধ করত। গোলমেশিন রাশ হয়তো খেলোয়াড়ি জীবনের অবসর নিয়েছেন। কিন্তু যতদিন ফুটবল বেঁচে থাকবে ফুটবলপ্রেমীদের মনে, বিশেষত অলরেডদের মনে এই গোলের ফেরিওয়ালা ইয়ান রাশ দ্যা ঘোস্টও আজীবন মনে থাকবে।