আর্জেন্টিনার বিশ্বজয় কি লাতিন ফুটবলের সুদিন ফেরাবে?

এক

একটা সিনেমায় যেভাবে আপাত পরস্পর সংযুক্ত নয় এমন সব অঙ্গকে সমন্বিত করার চেষ্টা একটা ভালো সিনেমার সম্ভাবনা তৈরি করে, তেমনি প্রতিটি দলীয় খেলাতেও প্রত্যেক খেলোয়াড়ের পজিশন আলাদা, দায়িত্বও আলাদা—মধ্যভাগ শক্ত না হলে আক্রমণে বল যোগান দেবে কে, রক্ষণভাগে শক্ত দেয়াল তৈরি না করলে গোল ডিফেন্ড হবে কিভাবে?

আগে লাতিন আমেরিকার দলগুলো দুই-একজন ফুটবলারের ওপর নির্ভর করে সাফল্য পেত। তবে সময়ের সঙ্গে ফুটবল আগের চেয়ে আরও বেশি দলগত খেলা হয়ে উঠেছে। কিন্তু লাতিন ফুটবল কোনও তারকা ফুটবলারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠার ধারা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। সেটা পেলে-ম্যারাডোনা থেকে হালের মেসি-নেইমার পর্যন্ত একই ধারা। কিন্তু ফুটবলে ধীরে ধীরে কৌশলে এসেছে পার্থক্য।

ছোট-বড়ো দলের মধ্যে থাকা পার্থক্য গেছে কমে। তারকা-নির্ভরতার চেয়ে একাধিক ভালো ফুটবলার তৈরিতে মনোযোগী হয়েছে দলগুলো। দলীয় এই খেলায় ক্রমে ‘ব্যক্তি’ থেকে ‘দল’ গুরুত্ব পেতে থেকেছে। গত দুই বিশ্বকাপে যথাক্রমে বেলিজিয়াম ও মরক্কোর পারফরম্যান্স, ’৯৮ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হবার পর ফ্রান্সের জায়ান্টে পরিণত হওয়া, ওই একই বিশ্বকাপে প্রথমবার বিশ্বকাপ মূলপর্বে সুযোগ পেয়ে ক্রমাগত উন্নতি করতে থাকা ক্রোয়েশিয়া—তার যথার্থ উদাহরণ।

দুই

২০০২ সালে লাতিন আমেরিকায় শেষবার বিশ্বকাপ নিয়ে গেছিল ব্রাজিল। তারপর এবারে আর্জেন্টিনা শিরোপা নেয়ার আগ পর্যন্ত টানা ২০ বছর শিরোপা-খরা কেটেছে লাতিন ফুটবলে। টানা ৪ বিশ্বকাপে ইউরোপীয় আধিপত্য দেখেছে ফুটবল। শিরোপা জেতার ইতিহাস ঘেঁটে দেখলাম, ১৯৩০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বকাপ নিয়ম করে গেছে দুই মহাদেশ অঞ্চলে; একবার ইউরোপে, পরেরবার লাতিন আমেরিকায়। ব্যত্যয় ঘটেছে দুইবার, যেখানে ইতালি ও ব্রাজিল টানা দুইবার করে জিতেছে।

বিশ্বমঞ্চে মূল লড়াই এই দুই মহাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। এই ১৮ বিশ্বকাপের মধ্যে ৯ বার ইউরোপে ও ৯ বার লাতিন আমেরিকায় বিশ্বকাপ যাতায়াত করেছে। প্রশ্ন হল ২০০৬ বিশ্বকাপের পর এই যাতায়াত একমুখী হয়ে গেল কেন? মহাদেশীয় টুর্নামেন্টগুলোর দিকে নজর দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদিকে ইউরো কাপে ডেনমার্ক-সুইডেন-সুইজারল্যান্ডের মত দলগুলো জায়ান্টদের বিপক্ষে সমানতালে লড়াই করে। অন্যদিকে কোপা আমেরিকার মূল লড়াই ঘুরেফিরে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-উরুগুয়ের মধ্যে থাকে। বাকি দলগুলো ইউরোপের মত যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারছে না।

কিন্তু কেন? ইউরোপের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফুটবলের পেছনে কেবল যথেষ্ট বিনিয়োগ রয়েছে তা নয়, ঘরোয়া ফুটবলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি আছে কৌশলগত বিষয় নিয়ে নানা বিচার-বিশ্লেষণ। অন্যদিকে লাতিন ফুটবলে আছে অনিয়ম, দুর্নীতি ও যথেষ্ট বিনিয়োগের অভাব। আর আছে পাইপলাইনে খেলোয়াড় তৈরির ঘাটতি। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বাদে অন্য দলগুলো থেকে নতুন প্রতিভা উঠে আসতে দেখাই যায় না। ক্লাব-ফুটবলে বহু আগে থেকেই দুই মহাদেশের অবস্থান বিপরীত মেরুতে।

অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়ে লাতিনের ক্লাবগুলোতে এখন ভালো ফুটবলারের সংখ্যা খুবই কম। তাদের বিখ্যাত ক্লাবগুলোর আগের সেই দাপট নেই। যদিও ম্যারাডোনা-রোমারিওরা ক্যারিয়ারের সেরা সময়েও লাতিনের ক্লাব ফুটবলে খেলে গেছেন। কিন্তু এখন যারা একটু ভালো খেলতে শুরু করেন তাদের অনেকেই ইউরোপে খেলতে চলে যান। ইউরোপিয়ান ফুটবলের একচ্ছত্র দাপটে তাই অনেকটাই ম্লান বর্তমান লাতিন ফুটবল।

তিন

উরুগুয়ে শেষবার কাপ নিয়েছে ৭২ বছর হয়ে গেছে। লাতিন আমেরিকার বাকি আট শিরোপা ভাগ হয়েছে দুই দলে—ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। অন্যদিকে ইউরোপের বারো শিরোপা ভাগ করে নিয়েছে পাঁচ দল—যথাক্রমে ইতালি, জার্মানি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও স্পেন। নেদারল্যান্ড তো বরাবরের শক্ত দল, পাশাপাশি সাম্প্রতিক অতীতে সোনালি প্রজন্মের হাত ধরে ক্রোয়েশিয়া ও বেলজিয়াম শিরোপার শক্ত দাবি জানিয়ে গেছে।

সফল হতে গেলে আপনাকে একটা ধরণ অনুসরণ করেই খেলতে হবে এমন কোন কথা নেই। খেলোয়াড়দের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকে, সেটাই তাদের একটা ধরণ গড়ে দেয়। তবে এই দুই মহাদেশের খেলার শৈলী আলাদা, ফুটবলদর্শনও। লাতিন ফুটবল মানে কেবল জালে বল জড়ানো না, মাঠে বল নিয়ে অবিশ্বাস্য সব কারিকুরি করে দেখানো।

ছোট ছোট পাসে সূক্ষ্ম স্কিলের প্রদর্শন দেখিয়ে যেন নৃত্য করতে করতে গোলের দিকে এগিয়ে যাওয়া; জালে বড় জড়াতে বিপক্ষের রক্ষণভাগকে বোকা বানাতে নিত্য-নতুন উদ্ভাবনী উপায় খোঁজা। ইউরোপিয়ান ফুটবলে কাউন্টার অ্যাটাকিং আর গতিময় ফুটবল প্রধান রণকৌশল হিসেবে থেকেছে। যেখানে যেকোনভাবে গোল করা মুখ্য বিষয়, কিভাবে এসেছে তার চেয়েও। তাদের কাছে নান্দনিকতার চেয়ে গতিময়তা বেশি কার্যকরী।

ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়ামের মতো দলগুলো এইসব কৌশল ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করে। আবার ইংল্যান্ডের খেলায় মাঝমাঠে বিল্ডআপ থাকে না, তারা লম্বা পাসে খেলতে বেশি আগ্রহী। ইতালি রক্ষণভাগ শক্ত রেখে কাউন্টার অ্যাটাকে যেতে পছন্দ করে। স্পেন বল নিজেদের দখলে বেশিক্ষণ রেখে আক্রমণে যায়।

চার

যদিও লাতিন ফুটবলারদের ইউরোপে নিয়মিত হওয়ার ফলে আগের মত খেলার ধরণে উভয়ের মধ্যে স্পষ্ট ব্যবধান নেই, তবুও আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে জমে উঠা এইবারের ফাইনালে কেউ কারও কাছে পরাস্ত হয় নি। মেসির স্কিলের সাথে এমবাপ্পের গতি পাল্লা দিয়ে লড়েছে।

দ্রুতগতির প্রতিআক্রমণনির্ভর ফুটবলের বিপরীতে তুলনামূলক ধীরগতির বিল্ডআপনির্ভর ফুটবলও দেখা গেছে। পুরো ম্যাচ তার পরতে পরতে চমক জমিয়ে রেখেছে। প্রথমার্ধের দুই গোলে এগিয়ে থাকা আর্জেন্টিনা যখন সহজ জয় দেখছিল, দ্বিতীয়ার্ধ শেষ হওয়ার ১০ মিনিট আগে এক মিনিটের ব্যবধানে দুই গোল করে এমবাপ্পে ম্যাচে ফ্রান্সকে সমতায় ফেরান।

অতিরিক্ত সময়ের ১৮ মিনিটে মেসির পা থেকে যখন গোল এলো, মনে হল ভাগ্যদেবী সম্ভবত মেসিকে দিয়েই জয়সূচক গোল করিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তখনও চমকের শেষ হয় নি, ম্যাচ শেষ হতে তখন ২ মিনিট বাকি, পেনাল্টি থেকে এমবাপ্পে আবার ফ্রান্সকে সমতায় ফেরান। ১২০ মিনিটেও যখন জয় নির্ধারণ হল না, সমতা ভাঙতে যেতে হল পেনাল্টি শুট-আউটের কাছে। ফাইনালে মাত্র ২য় ফুটবলার হিসেবে হ্যাট্রিক করেও এমবাপ্পে ফ্রান্সকে শিরোপা এনে দিতে পারলেন না। শিরোপা গেল গ্রেট মেসির দল আর্জেন্টিনার কাছে।

বর্তমান ফরম্যাটে একটা দলকে শিরোপা পেতে গেলে টানা ৭ ম্যাচে ভালো খেলে যেতে হয়। অর্থাৎ কোন দল যদি যে কোন একটা ম্যাচেও—ছন্দে না থাকে, তাদের বেশিরভাগ আক্রমণ বিপক্ষের ডিফেন্সে আটকে যায়, তাদের ইনফর্ম প্লেয়ার ভালো না খেলে—তবুও তাদেরকে সেই ম্যাচ জিততে হবে। সব পসিবিলিটিকে পক্ষে আনতে হবে, ভাগ্যকেও পাশে পেতে হবে। আর্জেন্টিনার পক্ষে ভাগ্যের মোক্ষম মুহূর্তটি ছিল ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ের শেষ মিনিটে ফ্রান্সের কোলো মুয়ানির শট থেকে মার্টিনেজের সেভ।

গত দুই বিশ্বকাপ দেখেছে দল হয়ে খেলতে গিয়ে ছোট-বড় দলের মধ্যে কমে আসা দূরত্ব। উভয় আসরে প্রত্যেক দলকেই গ্রুপপর্বে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হয়েছে। আগে সেই সতর্কতা আসত নকআউট পর্বে গিয়ে। গ্রুপপর্ব পার করা কোন দলকেই এইবার অপ্রতিরোধ্য মনে হয় নি, এতটাই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল প্রায় প্রতিটি ম্যাচ। সেই জায়গা থেকে আর্জেন্টিনার এই জয় নিঃসন্দেহে দলীয় কৃতিত্বেরই নজির দেয়। কিন্তু এই জয়ে ইউরোপের আধিপত্যে সত্যিই কি ভাগ বসানো গেল? নাকি লাতিন আমেরিকার এই জয় একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র?

পাঁচ

শেষ প্যারায় একটি অন্য আলোচনা দিয়ে শেষ করছি। ভিন্ন যুগের খেলোয়াড়দের কৃতিত্ব কি একই ফ্রেমে এনে দেখার সুযোগ আছে? কিংবা বিভিন্ন সময়ের খেলোয়াড়দের মধ্যে তুলনা করা কতটা যৌক্তিক? সমসাময়িক খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে (ক্রিকেটে শচীন-লারা, ফুটবলে মেসি-ক্রিশ্চিয়ানো) যা সহজে করা যেতে পারে। মানে অতীতের দলিল-দস্তাবেজ, তথ্য-উপাত্ত আর কিছু ভিডিও ফুটেজ দেখে কি একজন খেলোয়াড়ের গোটা ক্যারিয়ার মূল্যায়ন করা যায়?

চলচ্চিত্রে যেভাবে একজন পরিচালকের সকল সিনেমাকে আর্কাইভ করে রাখা যায়, কিন্তু ফুটবলে বা ক্রিকেটে একজন খেলোয়াড়ের ক্লাব-জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায় মিলে ম্যাচের সংখ্যা এত বেশি থাকে যে সেই সংখ্যাকে আর্কাইভ করা সম্ভব হয় না। লাইভ দেখা ছাড়া, সেগুলো কোনভাবে তা আর্কাইভ করা গেলেও ওই খেলোয়াড়ের প্রতিটা ম্যাচ দেখে যাওয়া যে কোন বিশ্লেষকের জন্য ভীষণ ক্লান্তিকর কাজ হবে।

প্রসঙ্গ ধরে জেনে রাখতে হবে ফিফার টুর্নামেন্টগুলো টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয় ১৯৫৪ সালের সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপ থেকে, সেই সম্প্রচার ইউরোপের অল্প কিছু দেশে সীমিত ছিল। কিন্তু ফুটবলের টিভি বিপ্লব শুরু হয় মূলত ১৯৬৬ সালের ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে। প্রথমবারের মত স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পুরো টুর্নামেন্ট সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। ওই বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটি পুরো দুনিয়ার ৪০০ মিলিয়ন মানুষ একযোগে টেলিভিশনে দেখেছিলেন। তাই একটা সময় পর্যন্ত মাঠের দর্শক হওয়া ব্যতীত খেলোয়াড়দের খেলা দেখে মূল্যায়ন করার তেমন সুযোগ ছিল না।

ক্রিকেটে, ডন ব্র্যাডম্যানের এক টেস্ট ব্যাটিং-গড়ের রেকর্ড ছাড়া ব্যাটিংয়ের প্রায় সব রেকর্ড শচীন টেন্ডুলকারের ঝুলিতে ছিল। কিন্তু শচীনের সময়ের ক্রিকেট-বিশ্লেষকেরা তার পুরো ক্যারিয়ারকে যেভাবে খুঁটিয়ে দেখেছেন, স্বাভাবিকভাবেই অতীতের সব গ্রেট ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ারকে সেভাবে দেখার সুযোগ হয় নি।

যদিও অতীত থেকে বর্তমানে আসতে আমরা বিভিন্ন যুগের বইপত্র, দলিল, তথ্য ও নানা ভিডিওর শরণাপন্ন হই। কিন্তু ইতিহাসে আমরা যতো পেছনে যাব পূর্ণাঙ্গ দলিলাদি ছাড়া কোন কিছু নির্ণয় করা ততোই মুশকিল হতে থাকে। কাজেই সময় ও প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণরূপে না জেনে উভয়ের মধ্যে কে ‘সর্বকালের সেরা’ সেটা নির্ধারণ হবে কিভাবে? ফুটবলের ক্ষেত্রেও তাই। কাজেই প্রতিটা খেলোয়াড়ই তার নিজস্ব প্রতিভায় অনন্য। আর এটাই খেলার সৌন্দর্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link