মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের সেই সকালের কথা মনে আছে? ভুলে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডকেই ধরাশয়ী করার ইতিহাস তো আর এত সহজে ভুলবার নয়। এবাদত হোসেনের বীরত্বে সেই টেস্টের প্রতিটা মুহূর্ত যেন এখনও তরতাজা স্মৃতি।
কিউইদের মাটিতে অন্য দলগুলোর খাবি খাওয়ার ঘটনা যেখানে স্বাভাবিক বলয়ের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল সেখানে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের টেস্ট ম্যাচটা বাংলাদেশ জিতেছিল নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। টেস্টে বাংলাদেশের আধিপত্য, বড্ড বেমানান শব্দ। তবে সেই শব্দটাই প্রয়োগ করতে বাধ্য করেছিলেন পেসার এবাদত হোসেন।
মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টের আগে এবাদত ছিলেন গড়পড়তা একজন পেসার। পরিসংখ্যানের মানদন্ডে তাঁকে বাতিলের খাতাতেই ফেলে দেওয়া যায় সে সময়। কিন্তু কিউইদের বিপক্ষে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের সে টেস্ট দিয়েই নিজের জাত চিনিয়ে ফেলেন তিনি। তাঁর ৪৬ রানের ৬ উইকেটের বোলিং স্পেলটি নিউজিল্যান্ডকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দেয়। আর এবাদতের এই বোলিং স্পেলই ক্রিকেট সাময়িকী উইজডেনের দৃষ্টিতে ২০২২ সালের সেরা বোলিং স্পেল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কেমন ছিল সেই স্পেল? ফিরে দেখা যাক এবাদতের সেই ঐতিহাসিক বোলিং স্পেল।
কিউইদের প্রথম ইনিংসে ৩২৮ রানের বিপরীতে বাংলাদেশের ৪৫৮ রান। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে সেখানেই টাইগারদের এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু ম্যাচ তো সেখানেই শেষ নয়। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামলো নিউজিল্যান্ড। ব্যাটিংয়ের ছন্দ এ ইনিংসে বোলিংয়েও দেখালো বাংলাদেশ। ৬৩ রানের মাঝেই তুলে নিল টম ল্যাথাম আর ডেভন কনওয়ের উইকেট। কিন্তু সেখান থেকেই আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলো কিউইরা।
উইল ইয়ং আর রস টেলর মিলে প্রতিরোধ গড়া শুরু করলেন। সে যাত্রায় তাঁরা সফলও হলো। একে একে তাঁরা নিরবচ্ছিনতায় কাটিয়ে দিল ২৯ ওভার। ম্যাচের চতুর্থ দিন তখন। টাইগারদের ম্যাচ হারার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু এমন একটা ম্যাচজয় কাছ থেকে ছুটে যাবে, সেটা যেন ভাবাই যাচ্ছিল না।
এমতাবস্থায় বোলিং প্রান্তে আসলেন এবাদত। ইনিংসের শুরু থেকেই দারুণ বোলিং করছিলেন। গতির সাথে ইনসুইং, বাউন্সার দিয়ে কিউই ব্যাটারদের রীতিমত অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছিলেন। কিন্তু ম্যাচ জিততে প্রয়োজন তো উইকেট। আর সবার বহুল প্রতীক্ষিত আউটের মুহূর্ত আসে সেই এবাদতে কল্যাণেই। উইল ইয়ংকে দারুণ এক আউটসুইংয়ে বিধ্বস্ত করলেন। ইয়ং সে সুইং সামলাতে না পেরে ক্যাচ দিলেন স্লিপে থাকা সাদমানের হাতে। সাদমানও সেটি লুফে নিলেন। দীর্ঘ সময় পর বাংলাদেশ পেল উইকেটের দেখা।
মূলত সে উইকেটেই ম্যাচের মোমেন্টাম চলে যায় বাংলাদেশের দিকে। ইয়ং আউট হওয়ার পর ক্রিজে আসেন হেনরি নিকোলস। আগের ইনিংসেই ৭৫ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস খেলেছিলেন। কিন্তু এবাদতের কাছে যেন পাত্তাই পেলেন না তিনি। ঐ ওভারেই বোল্ড হয়ে শূন্য রানে ফিরে যান তিনি। দিনের শেষভাগে আরও একটি উইকেট পায় বাংলাদেশ। সেটিও সেই এবাদতের কল্যাণে। এবার তিনি ফেরান টম ব্লান্ডেলকে। এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে নিকোলসের মতো তাঁকে শূন্য রানে ফেরান এবাদত।
১৩৬-২ থেকে ১৩৬-৫। মূহুর্তের মধ্যেই স্কোরকার্ড বদলে যায় এবাদতের সেই ভয়ংকর স্পেলে। কার্যত ম্যাচের চতুর্থ দিন শেষেই ম্যাচজয়ের সুবাস পেতে শুরু করে টাইগারররা। তবে একমাত্র বাঁধা হয়ে উইকেটে টিকে ছিলেন রস টেলর।
ম্যাচের পঞ্চম দিন। ইতিহাস গড়ার দ্বারপ্রান্তে টাইগাররা। সকালের শুরুতে রস টেলর কিছুক্ষণ ব্যাট করে উইকেটে প্রায় দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন। ম্যাচ বাঁচানোই তখন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু সে লক্ষ্যের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন এবাদত। আগের দিনেই নিজের ঝুলিতে ৪ উইকেট জমা করেছিলেন। ক্যারিয়ারের প্রথম ফাইফার পেতে তাই আর একটি উইকেটের অপেক্ষা।
সে মুহূর্তের মঞ্চস্থও হলো দুর্দান্তভাবে। এবাদত বল ছুঁড়লেন। বল ইনসুং হয়ে সোজা গিয়ে স্ট্যাম্পে ছত্রখান। রস টেলর যেন বলটা বুঝতেই পারলেন না। আউট হয়ে ফিরে গেলেন। সঙ্গে কিউইদের হারের ক্ষণ গণনাও শুর হয়ে গেল। ঐ দিকে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ফাইফারের আনন্দে ভেসে গেলেন এবাদত। সে আনন্দ যতটা না নিজের অর্জনের জন্য, তার চেয়ে বেশি বাংলাদেশকে জেতানোর নেপথ্যে থাকার কারণে।
রস টেইলর আউট হওয়ার পর আর দাঁড়াতে পারেনি কিউইরা। নিজের পঞ্চম উইকেট নেওয়ার পর এবাদত কাইল জেমিসনেরও উইকেট নিয়েছিলেন। আর এভাবেই শেষ হয় তাঁর ৪৬ রানে ৬ উইকেটের বোলিং ফিগার। নিউজিল্যান্ড ১৬৯ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ায় লিড পায় মাত্র ৪১ রানের। আর বাংলাদেশ সে লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ৮ উইকেট হাতে রেখেই।
বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে পাওয়া জয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও একই সাথে ঐতিহাসিক জয় ছিল মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের এ টেস্ট জয়। আর এ ম্যাচজয়ের নায়ক ছিলেন অবধারিতভাবেই এবাদত হোসেন। ভলিবল খেলোয়াড় হিসেবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এবাদত। কিন্তু সেই ভলিবল খেলোয়াড়ই পরবর্তীতে হয়ে যান পেসার। এর পরের ইতিহাসটা তো তিনি নিজ হাতেই লিখেছেন।
মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের সে টেস্টের এক বছর পেরিয়ে গিয়েছে। এই এক বছরে ভাগ্য বদলেছেন এবাদত নিজেও। সে সময় শুধুই লাল বলের ক্রিকেটে দেখা যেত এবাদতকে। এখন খেলছেন তিন ফরম্যাটেই। তবে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের এবাদত রূপে আর পাওয়া যায়নি তাঁকে। অবশ্য সেটা বলে এখনই রায় দিয়ে ফেলা নিতান্তই ভুল। এবাদতের পথচলা এখন পর্যন্ত আশা জাগানিয়া। তবে সেটা শুধু ‘সম্ভাবনাময়’ শব্দে আঁটকে না থাকুক। এবাদত সামনে নিজেকে উজাড় করে দিক, যেমনটি করে তিনি মাউন্ট মঙ্গানুইতে উড়েছিলেন।