ক্লাস সেভেনে পড়ি বোধহয়। ক্রিকেট নিয়ে তখন বেশ সিরিয়াস। স্কুলে অবশ্য আমাদের ক্রিকেট টিম সেরকমভাবে ছিল না। কিন্তু উন্মাদনা ছিল দুই সেকশনের মধ্যে ক্রিকেটে। সারাবছরে একটাই ম্যাচ হত, তাও আবার টেনিস বলে। টেনিস বলে মিডিয়াম পেস করতাম, আরও পরে ওয়াসিম আকরামের অ্যাকশন কপি করতাম।
ন্যাচারাল লেফট আর্ম স্পিনার হওয়ায় পেস বল করার সময়, বল নিজে থেকেই পড়ে অফকাট করত, ব্যাটসম্যানের জন্য একটা ন্যাচারাল অ্যাঙ্গেল দিত। এমত অবস্থায় আবিষ্কার করলাম লেগ কাট করাতে গেলে অ্যাকশন একটু স্লো করতে হবে। প্রথম পরীক্ষা করলাম সেই স্কুলের টেনিস বলের ম্যাচে। বলটা একটু নরম হয়ে গেছিল। তাই রান আপ স্লো করে বল করতে তিন উইকেট।
এসব বলার কারণ, যার অ্যাকশন তখন কপি করেছিলাম তিনি তদ্দিনে ভারতকে একটা বিশ্বকাপ দিয়ে দিয়েছেন। বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপেও জুতসই পারফর্ম করেছেন। কিন্তু তদ্দিনে নাম কিনেছেন সবরকম আউট হয়ে। সবরকম বলতে টাইমড আউট হননি।
যদিও একবার অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাট করতে নামতে দু-মিনিটের বেশি সময় নিয়ে ফেলেছিলেন। বর্ডাররা খেয়াল করেননি বলে… কিন্তু দু-দুবার হিট উইকেট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, আর একবার গ্রেগ ম্যাথুজের অফস্পিনে হ্যান্ডলেড দ্য বল। তার উপর রাজ সিং দুঙ্গারপুরের নেতৃত্বে সমগ্র নির্বাচকমণ্ডলীকে জোকার সভা বলে অভিবাদনও করে ফেললেন।
তাহলে মহিন্দার অমরনাথ কেন? বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল আর ফাইনালে ম্যান অব দি ম্যাচ হয়েছিলেন বলে? নাকি ওঁর বোলিং অ্যাকশন, ওই হেলেদুলে বলটা জাগলিংয়ের মুদ্রায় নিয়ে এসে বোলিং ক্রিজের সামনে ফুট করে বাঁ হাত তুলে ডান হাত দিয়ে কাটার, আর আউটস্যুইং, যেটা কপি করেছিলাম, তার জন্য?
নাকি ঠিক যে সময়টা থেকে ক্রিকেট ভালো করে বুঝতে শিখেছি, সেই সময় দুই মারাত্মক পেস ব্যাটারির বিপক্ষে ভগবানের মতো ব্যাটিং করা? মনে হয় শেষটাই কারণ। অবশ্য দ্বিতীয়টাও হতেই পারে। একটা সেন্স অব বিলঙ্গিংনেসও তো আছে। প্রত্যেক অমিতাভ বচ্চন ফ্যান, কান ঢাকা বাবরি আর ব্যারিটোনে বচনের পার্সোনালিটির ২ শতাংশও কি ধার নেয় না? নাকি আজহারের ফ্যানরা কলার তুলে পা ছেতরে ডান কাঁধ ঝুঁকিয়ে হাঁটে না?
ঠিক কী ছিল মহিন্দারের ব্যাটিং? ফ্রন্টফুটের উপর অতিরিক্ত ভর দিয়ে ব্যাট ঠুকে, ইনিশিয়াল শাফলিং অফ মিডে করে মিনিমাম ব্যাকলিফটে কবজির জোরে খেলা। তাতে তো কভার ড্রাইভ ভালো হবার কথা। আর এই খেলায় ইনকামিং ডেলিভারিতে সমস্যা হবার কথা।
হয়ওনি কি? শারজায় ১২৫ অলআউটে মনে করুন ইমরানের ইনডিপারে লেগ স্টাম্প ছিটকে যাবার গল্প। কিন্তু সেটাকে সামলাবার জন্য মুভিং বলে একটু বাইরে পা নিতে শুরু করলেন, আর রানও আসতে শুরু করল। পরপর পাকিস্তান আর বিশ্বকাপের আগেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ। ৮২-৮৩।
৩-০ জেতার পর ইমরান পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলেন, এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানের নাম মহিন্দর অমরনাথ। তিন ভাইয়ের মধ্যে মেজো মহিন্দার। ছোটো রাজিন্দার ইন্ডিয়া খেলেননি, কিন্তু চুটিয়ে দিল্লির হয়ে খেলেছেন। বড়ো সুরিন্দার এবং বাবা লালা দুজনেই টেস্টে অভিষেকে শতরান করেছেন।
কিন্তু, আর কখনোই সেঞ্চুরি পাননি। মহিন্দার সেসব রাস্তায় হাঁটলেন না। অভিষেকের প্রায় বছর নয় পরে প্রথম সেঞ্চুরি করলেন, তাও পার্থের মতো বাউন্সি এবং দ্রুতগতির উইকেটে। জেফ থমসনের মতো বোলারের বিপক্ষে। সেই সিরিজেই মাথায় চোট পেলেন। চোট আরও একবার পেয়েছেন, ব্রিজটাউনে মার্শালের বলে চোট পেয়ে থুতনিতে সেলাই করাতে গেলেন। ফিরে এসে হোল্ডিং-এর বাউন্সারে হুক করে ছয়।
হুক, ভারতীয় ক্রিকেট থেকে হুক শব্দটাকে আংটা দিয়ে তুলে আনতে হবে। গাভাস্কার প্রথম সিরিজের পর আর বার করেননি বারো বছর। কপিল একটা মারতেন বটে, কিন্তু তিনি তো নটরাজ। ভারতীয় টপ অর্ডার ব্যাট নন। দিলীপ বেঙ্গসরকার একটা পুল করতেন, শর্ট আর্ম পুল। কিন্তু ইনিশিয়াল ফ্রন্ট ফুট শাফল করার পর বাঁ কানের পাশের বলটাকে ফাইন লেগ আর লং লেগের মাঝের রাস্তা দেখানো নিয়মিতভাবে, কাজটা একজনই করেছেন। ওই যে জিমি অমরনাথ। পকেটে তাঁর লাল রুমাল, মাথায় ভাইজার ছাড়া হেলমেট।
আসলে গাভাসকার বলেছেন না পরাজয় স্বীকার করা জিমি অমরনাথের অভিধানে নেই। ছিল না। তাই বারবার বাইরে গিয়েও ফিরে এসেছেন তিনি। ১৯৬৮-৮৮ পর্যন্ত খেলেছেন মাত্র ৬৯টা টেস্ট, বাদ পড়েছেন আরও প্রায় ৬৩টা টেস্টে। বারবার বাদ পড়েও ফিরে এসেছেন। বারবার লড়ে গেছেন।
লড়াকু মনোভাবের চূড়ান্ত নিদর্শন রেখে দিলেন ২৫শে জুন ১৯৮৩। ভারতের ১৮৩ তাড়া করে প্রথমদিকের উইকেট হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৭৬-৬। খেলা ধরেছেন দুজঁ আর মার্শাল। ৪৩ রান জুড়েছেন তাঁরা। সবাই ভাবতে শুরু করেছে, আর বুঝি হল না। বিশ্বত্রাস ওয়েস্ট ইন্ডিজ তৃতীয়বারের মতো প্রুডেনশিয়াল বিশ্বকাপ জিতে নিচ্ছে। কিন্তু ওই যে প্রেসবক্স এন্ড থেকে হেলতে দুলতে আসছেন মহিন্দার ‘জিমি’ অমরনাথ! বলটা অফকাট করল অফস্টাম্পের বাইরে থেকে, জেফ দুজঁ পা নিলেন ব্যাট নিলেন।
কিন্তু বৃথা সেই নেওয়া। অফ মিডলের বেলটা তখন উইকেট কিপার কিরমানির মুঠোয়। ম্যাচও ভারতের হাতে। মুঠোয় পোক্ত হল পরের ওভারের আর-একটি অফকাটারে। মার্শালের ব্যাটটা একটু দেরিতে নেমেছিল, কানা লেগে বল গাভাস্কারের তালু হয়ে পকেটে। ম্যাচও ভারতের পকেটে। চমচমের উপরের মালাইয়ের মতো নিচু হয়ে আসা অফকাটে তুললেন মাইকেল হোল্ডিংকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৪০, ভারত বিশ্বজয়ী।
তারপর? তারপর প্রতিশোধের সিরিজে একদম উলটো গল্প। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভারতকে দুরমুশ করে টেস্টে ৩-০ সীমিত ওভারে ৫-০ হারাল। মহিন্দারের ব্যাটিং গড় টেস্টে মাত্র ০.১৬! তার আগের বছরের সিংহবিক্রম তারপরেই খরচের খাতায়। এভাবে বারবার বাদ পড়েও ফিরে এসেছেন। ৮৮-তে আর হল না। ফেটে পড়লেন তিনি।
নির্বাচকরা তখন জোকার সভা। তার আগে আগেই এশিয়া কাপে যথেষ্ট ভালো ফর্মে ছিলেন তিনি তবুও। অবশ্য, কানাঘুষো শুনতে পাওয়া যায় যে নবজ্যোত সিং সিধুর ছয় মারার ক্ষমতায় প্রভাবিত হয়েই আটত্রিশ বছরের মহিন্দারকে বাদ দেওয়া হয়। বহুক্ষেত্রে রবি শাস্ত্রী বারবার বদান্যতা পেয়েছেন, গাভাসকারও। কিন্তু মহিন্দার অমরনাথ নন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো অদ্ভুতুড়ে ফর্মের মধ্যেই লেখা ছিল অথবা অন্য কোনকিছু!
৮২ পর্যন্ত প্রথম তেরো বছরে, ছাব্বিশটা টেস্ট খেলে মাত্র তেরোশ রান। পরের এগারোটা টেস্টে বিশ্বসেরা সাড়ে এগারোশ। আবার পরের পাঁচ বছরে সাধারণ চল্লিশের নিচে গড়। এই হলেন ভারতীয় ক্রিকেটের কামব্যাক ম্যান। পেস ব্যাটারির বিরুদ্ধে আশির দশকে অন্যতম সেরা ব্যাট।
কিন্তু, অদ্ভুতভাবে ঔদাসীন্যে সাধারণ এক ক্রিকেট মস্তিষ্কের গল্প। ভারতের হয়ে কোচিং কখনোই করেননি। কিন্তু যে সময় গ্যারি কার্স্টেন কোচ হন, সেই সময় নাকি কোচ হবার সাক্ষাৎকারে মহিন্দারের পরিকল্পনায় চমৎকৃত হয়েছিলেন কর্তাব্যক্তিরা। সাদা চামড়ার প্রতি অবিমিশ্র মোহে মহিন্দরের আর ফিরে আসা হয়নি ভারতীয় ক্রিকেটে।
বঞ্চিত থেকেছি আমরা, যারা সেই সোনার সময়ে মহিন্দরকে দেখেছি। মুখে লাগল, ইমরানের বলে মাথায় লাগল, কুছ পরোয়া নেহি। পরের বলটাই অবলীলায় স্কোয়ার লেগ বা লং লেগের বিলবোর্ডে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসতেই পারে।
এই বিশ্বাসে প্রায় ১৯ বছর খেলে গেছেন মহিন্দর অমরনাথ। ইতিহাসে তাঁর জন্য একটাই অধ্যায় বরাদ্দ রেখেছিলেন ক্রিকেট বিধাতা। সেই লর্ডসের ব্যালকনি, নীল ব্লেজারে গোঁফ সমেত একটা হাস্যময় মুখ। রুপোলি ট্রফিটাকে তুলে ধরে রয়েছেন। স্মরণীয় সময়ের স্মরণীয়তম পারফরম্যান্স রেখে নিবে যাওয়া এক উজ্জ্বল রংমশাল। মহিন্দার অমরনাথ ভরদ্বাজ। দিল্লীর ক্রিকেটের এক অত্যাশ্চর্য প্রতিভূ। আমাদের কৈশোরের লড়াইয়ের বাস্তব চিত্র তিনি।