হাতুুরুসিংহের প্রত্যাবর্তনের এপিঠ-ওপিঠ

পুরোনো দায়িত্বে আবারো নতুন করে ফিরছেন চান্দিকা হাতুরু সিংহে। দলে কড়া মাস্টারের ভূমিকাটা ফিরিয়ে আনতে উন্মুখ হয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। সে কারণেই কিনা রাসেল ডমিঙ্গোর সাথে চুক্তি শেষ হবার বহু আগেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলার সময় অস্ট্রেলিয়ায় বসেই হাতুরুর সাথে পাঁকা কথা সেরে রেখেছিলেন বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন।

এতদিন টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে ফরম্যাটের জন্য কোচ হিসেবে শ্রীধরণ শ্রীরামের নাম শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত সব ফরমেটের কোচ হিসেবেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের দায়িত্ব নিচ্ছেন লঙ্কান এই কোচ।

হাতুরুসিংহের আমলেই নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা সময় কাটিয়েছিল বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে চরম বাজে সময় পার কর‍তে থাকা বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নেন হাতুরু। খাদের কিনারায় থাকা দলকে টেনে তুলে বিশ্বকাপে নিয়ে যান তিনি।

সেখানে নিজেদের ইতিহাসে প্রথম বারের মত কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের পরপরই ঘরের মাঠে সিরিজ জেতে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর নিজের প্রাথমিক দুই বছরের চুক্তি ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত বাড়ান হাথুরু। তবে বর্ধিত চুক্তির অর্ধেক মেয়াদও শেষ করতে পারেননি তিনি।

সে দফায় হাতুরুর বিদায়টা হয়েছিল অনেকটা অপেশাদারিত্ব দিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ শেষ করে বাংলাদেশে না ফিরেই পদত্যাগের কথা জানিয়ে দেন তিনি। এমনকি সেই সিরিজের রিপোর্টও বোর্ডে জমা দেবার প্রয়োজন মনে করেননি হাতুরু। বোর্ড সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন তিনি।

এমন বিতর্কিত বিদায় হবার পর সেই হাথুরুসিংহের বাংলাদেশের কোচ হয়ে ফেরাটা তাই একটু হলেও চমকপ্রদ। হাতুরুর পরবর্তীতে বাংলাদেশের দায়িত্ব পালন করা স্টিভ রোডস বা রাসেল ডমিঙ্গোর রেকর্ড হাথুরুর চেয়ে ভালো থাকলেও বাংলাদেশ দলের জন্য হাথুরুর মত কড়া হেড মাস্টার সুলভ কাউকেই এতদিন খুঁজে এসেছে বিসিবি।

হাতুরুর প্রত্যাবর্তনে তাই আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠাটা অনেকটাই প্রত্যাশিত। সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি মুর্তজাও মনে করেন বাংলাদেশের জন্য দৃষ্টান্তটি ভালো হয়নি খুব একটা, ‘টেস্ট খেলুড়ে দেশের মর্যাদা হিসেব করলে এটি নিশ্চই ভালো কোনো দৃষ্টান্ত নয়। জেমি সিডন্সকেও ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তারা দুইজনই টেকনিক্যালি এবং ট্যাক্টিক্যালি আমার দেখা সেরা দুইজন কোচ। সম্ভবত সেই কারণেই বোর্ড তাকে ফিরিয়ে এনেছে। অন্যদিকে, বিশ্বজুড়ে কোচের সংকটও রয়েছে। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের যুগে কোচ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এদিক থেকে বলা যায় বিসিবি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

হাথুরুসিংহে ফেরাটা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে আশা করলেও হাথুরুর চলে যাবার প্রক্রিয়াকেই সামনে আনলেন মাশরাফি, ‘সে যদি সিডন্সের মত বিদায় নিত তাহলে কোনো সমস্যা থাকত না। সিডন্স ব্যাটিং কোচ হয়ে হলেও বাংলাদেশে থেকে যেতে চেয়েছিল। হাতুরু চুক্তির মাঝপথেই চলে যায়। সে আমাদের বোর্ড প্রেসিডেন্টের ফোনও ধরেনি, এসএমএসের রিপ্লাইও দেয়নি। হঠাত করেই চলে গিয়েছিল সে। এই জায়গাতে প্রশ্ন থেকেই যায়।’

হাথুরুকে ফিরিয়ে আনতে পেরে অবশ্য খুশি বিসিবি কর্তারাও। বিসিবি ক্রিকেট অপারেশন্স চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস বলেন, ‘আমরা খুশি। সে এখানে আগেও কাজ করেছে তাই মানিয়ে নিতে বেশি সময় লাগবে না তাঁর। সে খেলোয়াড়দের এবং এখানকার পরিবেশ সম্পর্কে ভালো জানে। সে একজন ভালো কোচ। খেলোয়াড়দের জন্য প্রয়োজনীয় গুণগুলো তাঁর আছে। সে সব সময় বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ দেখিয়ে এসছে। আশা করি এবার সে দীর্ঘ মেয়াদে এখানে থাকবে এবং চুক্তির বিষয়াদি মেনে চলবে। সে আমাদের যা বলেছে, আমরা আশা করছি আগামী দুই বছর সে আমাদের জন্য ভালোভাবে কাজ করবে।’

হাতুুরুসিংহের আমলে সাদা বলের ক্রিকেটে বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফি অবশ্য কিছুটা সন্দিহান হাতুরু আসার পর ড্রেসিংরুমের অবস্থা নিয়ে, ‘ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড়েরা তাকে কিভাবে গ্রহণ করবে সে নিয়ে একটা বড় প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সে এবং খেলোয়াড়েরা ড্রেসিংরুমে একে অপরের সাথে কম্ফরটেবল কিনা। দুই-চারজন নতুন মুখ বাদে তার প্রথম মেয়ারদের সব খেলোয়াড়রাই আছেন এই দলে। হাথুরুসিংহে আন্তর্জাতিক কোচ। আমি নিশ্চিত সে সব কিছু ঠিকঠাক করে নেবে। যত তাড়াতাড়ি এটি হবে ততই ভাল।’

এছাড়াও আরো অনেক শক্তিশালী ভূমিকা নিয়েই এবার কোচ হয়ে আসছেন হাতুরুসিংহে, এমনটাই মনে করেন মাশরাফি। তবে হাতুরুর এই ভূমিকা দেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো হবে না, খারাপ হবে তার অনেকটাই নির্ভর করছে তাঁর কতটা নিয়ন্ত্রণ বিসিবির কাছে থাকে সেটির ওপর। তবে মাশরাফি আশাবাদী বাংলাদেশের বর্তমান দুই অধিনায়ক সাকিব আল হাসান আর তামিম ইকবালের সাথে ভালোই মানিয়ে নেবেন হাতুরু।

আগের মেয়াদে চুক্তি নবায়নের পর সরারি নির্বাচক কমিটির অংশ বনে গিয়েছিলেন হাতুরু। দল নির্বাচনে কোচের এমন সরাসরি হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ করে তখন পদত্যাগ করেছিলেন সাবেক প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ। হাথুরুর আগের মেয়াদে বিদায়ের প্রক্রিয়ার বিষয়টি সামনে আনলেন তিনিও। ওমন বিতর্কিত বিদায়ের পর নতুন মেয়াদে কতটা দেশের ক্রিকেটকে দিতে পারবেন হাথুরু সে নিয়ে সন্দিহান ফারুক।

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি বিসিবি অনেক উচ্চ আকাঙ্ক্ষা  নিয়ে হাথুরুকে ফিরিয়ে এনেছে । কিন্তু বোর্ড সম্ভবত ভুলে গেছে হাথুরু আগেরবার কিভাবে বিদায় নিয়েছিল। সাধারণত যারা এভাবে বিদায় নেয় তারা পরবর্তীতে ভালো কিছু দিতে পারে না। দুই পক্ষই আগের সেই ঘটনা গুলো মাথায় রাখবে। যদি সে স্বাভাবিকভাবে বিদায় নিত তাহলে তাঁর প্রত্যাবর্তন নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকত না।’

নতুন মেয়াদে হাতুরুর সফল হবেন কিনা তা নিয়ে সন্দিহান ফারুক আহমেদ। ঘটনা প্রবহ হাথুরুর জবাবদিহিতাকে আরো কমিয়ে দেবে বলেই মনে করেন তিনি। তবে নতুন মেয়াদে সব কিছু সমন্বয় করে নিজের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করবেন হাথুরু এমনটাই আশা করেন সাবেক এই অধিনায়ক। হাথুরুর কোচিংয়ের ধরণ নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও পূর্বের বিদায়ের অম্ল অভিজ্ঞতাই সবাইকে হাথুরুর প্রত্যাবর্তন নিয়ে আবারো ভাবতে বাধ্য করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link