মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে আলোচনায় থাকাটা যেন তাঁর মজ্জাগত। মাঠের অলরাউন্ডার সত্ত্বটা টেনে নিয়েছেন আপন জীবনেও। মাঠ কিংবা মাঠের বাইরের সবকিছুই যে সামলান সুপারম্যান স্টাইলে। তিনি সাকিব আল হাসান, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সুপারম্যান।
আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে ২৫ ওভার পর্যন্ত যেন খানিকটা নিশ্চুপ রইলেন। অফস্পিনার হ্যারি টেক্টরকে আসতে দেখেই কিনা একটু খোলস ছেড়ে বেরোতে ইচ্ছে করলো, প্রথম বলটাকেই সুইপ করে পাঠালেন সীমানার বাইরে।
পরের বলটাকেই পাঠালেন কভারের ফিল্ডারের মাথার উপর দিয়ে বাউন্ডারির জন্য। সেই ওভারে আরো তিনটি চার আদায় করে বদলে দিলেন বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের মোমেন্টাম। ৩০০ পেরোনোর সম্ভাবনা আরো জোরালো হলো, সাকিবও এগোলেন ব্যক্তিগত সেঞ্চুরির পানে।
নাহ ! সাকিব শেষ পর্যন্ত সেঞ্চুরিটা পাননি, ফিরতে হয়েছে শতক থেকে সাত রান দূরে থাকতেই। তবে বাংলাদেশ কিন্তু ঠিকই পেয়েছিল সাড়ে তিনশো ছুঁইছুঁই সংগ্রহ। এরপর বোলিংয়েও সাকিব চমক, ক্রমশই ভয়ংকর হয়ে ওঠা আয়ারল্যান্ডের ৬০ রানের উদ্বোধনী জুটি ভেঙ্গেছেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়। তাঁরই বেঁধে দেয়া সুরে ম্যাচের পরের সময়টুকু ছড়ি ঘুরিয়েছেন বোলারা, বাংলাদেশ তুলে নিয়েছে ওয়ানডে ফরম্যাটে তাঁদের সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়।
অথচ দিন কয়েক আগে কি ঝক্কিঝামেলাই না পোহাতে হলো সাকিবকে! দুবাইতে স্বর্ণালংকারের দোকান উদ্বোধন করা নিয়ে তো গোটা বাংলাদেশকেই যেন দুভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন সাকিব। সেই দোকানের মালিক হত্যা মামলার আসামি – এমন তথ্যের সুবাদে তো উত্তাল হয়ে উঠেছিল সংবাদমাধ্যম, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও জানিয়েছিল প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে এই তারকাকে।
বিসিবি অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপের কথা জানায়নি। ক্রিকেট অপারেশন্স চেয়ারম্যান জালাল ইউনূসের মতে, সাকিবের এহেন বাণিজ্যিক প্রচারণা বিসিবির কোড অব কন্ডাক্ট ভাঙেনি। তাছাড়া সাকিব তাঁদের আগেই জানিয়েছিলেন তিনি দলের সাথে সিলেটে যোগ দেবেন ম্যাচের আগের দিন।
এই ঘটনার এক সপ্তাহ আগে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় টি-টোয়েন্টি শেষেও সাকিব চট্টগ্রামে এক দোকান উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে যাবার পথে ঘটিয়েছেন আরেক কান্ড। গাড়ি থেকে নেমে দোকানে যাবার পথেই তাঁকে দেখতে পেয়ে ভিড় জমিয়েছিল উৎসুক জনতা। সেই ফাঁকেই কিনা একজন চেষ্টা করলেন সাকিবের ক্যাপটা চুরি করে নিয়ে যেতে।
কিন্তু ‘পড়বি পড় মালির ঘাড়ে’, চোর বেচারার ভাগ্য সেদিন নেহায়েত খারাপ ছিল। সে ধরা পড়লো সাকিবের হাতে, ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় ক্যাপ তো সাকিব উদ্ধার করেছেনই পাশাপাশি ক্যাপ দিয়েই কয়েক ঘা লাগিয়েছেন সেই চোরকে।
এবারে আরেকটু পিছিয়ে যাওয়া যাক, জানুয়ারিতেই রীতিমতো বিস্ফোরক মন্তব্য করেছিলেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) নিয়ে। কোনো খেলোয়াড় তো দূর, কোচ কিংবা মালিকপক্ষও যা বলার সাহস করেনি, সাকিব সেটাই করলেন।
বলেই বসলেন তিনি সিইও হলে বদলে ফেলতেন গোটা টুর্নামেন্টের চেহারা। কেবল মাঠের বাইরে নয়, মাঠের খেলাতেও প্রথম সপ্তাহেই দুবার আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তর্কে জড়িয়ে গেলেন মাঠের মাঝেই। এসব সত্ত্বেও টুর্নামেন্ট শেষ করলেন ৩৭৫ রান এবং দশ উইকেট নিয়ে!
বিতর্কিত ঘটনা এবং মাঠের পারফরম্যান্স – দুটোই যেন সাকিবের জীবনের নিয়মিত বিষয়। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই মাঠের বাইরে বরাবরই বিতর্কিত সব ঘটনার জন্য শিরোনাম হয়েছেন। তবে সবকিছু সত্ত্বেও মাঠে বরাবরই পারফর্ম করে গেছেন। বাইরের সবকিছু সামলে তিনি কিভাবে এতটা অনবদ্য সেটা বোধহয় গোটা ক্রিকেটবিশ্বের কাছেই বিস্ময়। বিকেএসপিতে স্কুলের দিনগুলো থেকে আজকের ফরচুন বরিশালের কোচ হবার সুবাদে সাকিবকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন নাজমুল আবেদিন ফাহিম।
তাঁর মতে, ‘এটা আসলে খুব আশ্চর্যজনক একটা ব্যাপার। সে চাইলেই একটা বাবলে ঢুকে যেতে পারে যেখানে বাইরের কিছুই তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। সে একদম শেষমূহুর্তেও নিজেকে সামলে নিতে জানে। তাঁর মাঝে এই ব্যাপারটা আছে। যেকোনো পরিস্থিতিতে মাঠে সে নিজের সেরাটা দিতে পারে। সবসময় ইতিবাচক মানসিকতা রাখে, কখনো পেছনে ফিরে তাকায় না। এটা সম্পূর্ণ মানসিক ব্যাপার, আপনি এটা কাউকে কখনো শেখাতে পারবেন না।’
গত বছরও বেশ কয়েকবার সাকিবের ব্যবসায়িক মানসিকতার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক হয়েছে বিসিবি সিদ্ধান্ত। একবার তো বিসিবির নিষেধে এক বেটিং কোম্পানির সাথে চুক্তি বাতিল করতে হয়েছে। এই ঘটনার পরই এশিয়া কাপ এবং বিশ্বকাপের ঠিক আগমূহুর্তে টি- টোয়েন্টি দলের অধিনায়কত্ব পান সাকিব। তাঁর অধীনেই খোলনোলচে পাল্টে যায় বাংলাদেশ দলের, নিজেদের স্মরণকালের সবচেয়ে ভালো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কাটায় টাইগাররা। গত বছরের মার্চে তো শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাবার ব্যাপারে অনীহা দেখালেও কয়েকদিনের নাটকীয়তা শেষে রাজি হন।
দুই বছর আগে তো একবার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে লাথি দিয়ে স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলেছিলেন ম্যাচের মাঝেই। সেই ঘটনা থেকেও ফিরে এসেছেন সাকিব। এর মাঝে একটা কারণ অবশ্য গত কয়েক বছরে সাকিবের প্রতি বিসিবি যথেষ্ট নমনীয়।
কেবলমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যেতে না চাওয়া এবং বেটিং কোম্পানির সাথে চুক্তি বোর্ডের নীতিমালা ভঙ্গ করায় বিসিবি কঠোরতা দেখিয়েছে। এমনকি স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলার পরও তাঁকে মাত্র তিন ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিসিবি সাকিবের নিষেধাজ্ঞা কমিয়েছে কিংবা এড়িয়ে গেছে।
মাঠ বিভিন্ন সময়ে সাকিব ব্যাটিংয়ের ব্যর্থতা ভুলিয়ে দেন বোলিংয়ে পারফর্ম করে। মাঠের বাইরেও জীবনেও তাই, নানা বিতর্কিত সব মূহুর্ত তিনি নিমেষে ভুলিয়ে দিয়েছেন মাঠের পারফরম্যান্সে। সাকিব সত্যিকার অর্থেই এক অলরাউন্ডার।