লিটন দাস, পূর্ণাঙ্গ টি-টোয়েন্টি দানব

গড়টা ২৩ ছুঁইছুঁই, ২২.৮২। মোটেই দারুণ কিছু নয়। স্ট্রাইকরেট ১৩০। আহামরি কিছু নয়, তবে মন্দও নয়। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে লিটন দাসের ব্যাটিংয়ের চিত্রটা ঠিক এমন। পরিসংখ্যানের এমন খেরোখাতা নিয়ে বসলে, লিটন নি:সন্দেহে পিছিয়ে। কিন্তু পরিসংখ্যান নামক ঐ আঙ্কিক সমীকরণেই আবার লিটন দেশের সেরা। পরিস্থিতি বিবেচনায় দারুণ কার্যকরী ব্যাটার। যার হাতে ইনিংস শুরুর দায়িত্ব দিয়ে দল নির্ভার থাকতে পারে। কিভাবে? চলুন দেখে নেওয়া যাক।

প্রথমত, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ১০০০ রান করেছেন এমন বাংলাদেশি ব্যাটারেদের মধ্যে কেউই ব্যাটিং গড় ২৫ টপকাতে পারেননি। সবার ঐ ২৩, ২৪ গড়েই ক্যারিয়ার উঠানামা করেছে। তাই লিটন দাস এখানে খুব পিছিয়ে আছেন, সেটি মোটেই বলা যাবে না। বরং সবাইকে ছাপিয়ে যাওয়ার দারুণ একটা সম্ভাবনা আছে তাঁর মাঝে। অন্তত বাংলাদেশি ব্যাটারদের মধ্যে সবচেয়ে কম ইনিংসে (৬৮) ১৫০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করা সেই ইঙ্গিতই দেয়।

দ্বিতীয় বিবেচ্য বিষয়ে, লিটন দাস একদম সবার শীর্ষে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সহস্রাধিক রান করা বাংলাদেশি ব্যাটারদের মধ্যে স্ট্রাইকরেট ১৩০ পেরিয়েছেন মাত্র ১ জন। সেই একমাত্র ব্যাটারের নাম – লিটন দাস।

একটা পরিসংখ্যান লিটনের এই স্ট্রাইকরেটের মাহাত্ম্যকে আরেকটু বাড়িয়ে দিতে পারে। সেটি হলো- লিটন দাস বাদে বাংলাদেশি কোনো ব্যাটার এখন পর্যন্ত ১২৫ স্ট্রাইকরেটই টপকাতে পারেননি। এই মুহূর্তে দলে থাকা ব্যাটারদের মধ্যে লিটন বাদে সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেট সাকিবের, ১২১.৮৭।

লিটন দাস দলে উড়ন্ত শুরুর ক্ষেত্রে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে তা প্রমাণ হয়েছে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টিতেই। ২৩ বলে ৪৭ করেছেন। দলের সর্বোচ্চ স্কোরার তিনি নন। তবে বাংলাদেশকে উড়ন্ত শুরু আর ২০০ এর পথে পা বাড়ানোর স্বপ্ন তিনিই দেখিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে গড়পড়তা গড়ওয়ালা লিটনের পক্ষে একটি দারুণ পরিসংখ্যান কথা বলবে।

ব্যাটিং স্ট্রাইকরেট ১৩০ হলেও তিনি তাঁর ক্যারিয়ারে পাওয়ার প্লে তে ব্যাটিং করেছেন ১৪১ স্ট্রাইক রেটে। আর এখানে লিটনের ধারের কাছেও কেউ নেই। লিটনের পরে পাওয়ার প্লেতে বাংলাদেশিদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্ট্রাইকরেট সৌম্য সরকারের, ১২২।

লিটন তাঁর ক্যারিয়ারে ৯ টা অর্ধ-শতক হাঁকিয়েছেন। আর ৪০+ ইনিংসের হিসেবে সংখ্যাটা ১৪। বড় ইনিংস খেলার পথে লিটন কতটা বিধ্বংসী হয়ে ওঠেন তার প্রমাণ মিলবে এখানেই। ক্যারিয়ারের ৯ টা অর্ধশতক ইনিংসের মধ্যে ৬ টিতেই লিটন ১৫০ এর বেশি স্ট্রাইকরেট রেখে ব্যাট করেছেন। আর ৪০+ ইনিংসের ক্ষেত্রে ৯ বার ১৫০ স্ট্রাইকরেট ছাড়িয়েছেন। এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে লিটনের ইনিংস বড় হওয়ার সাথে সাথে তিনি কতটা দুর্দান্ত হয়ে উঠতে পারেন।

পরিসংখ্যানের জট ছাড়িয়ে এবার লিটনের কার্যকরী ইনিংস গুলোর দিকে তাকানো যাক। ২০১৮ সালে নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে রেকর্ড ২১৫ রান তাড়া করে জিতেছিল বাংলাদেশ। ম্যাচসেরা হয়েছিলেন মুশফিক। তবে আড়ালে যেটি থেকে যায় সেটি হলো, সে ম্যাচে বাংলাদেশকে জয়ের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিলেন কিন্তু লিটন। তাঁর ১৯ বলে ৪৩ রানের ক্যামিওতেই দারুণ একটা শুরু পায় বাংলাদেশ। আর ঐ দুর্দান্ত শুরুর রেশ ধরেই ম্যাচে জয় পায় বাংলাদেশ।

দলের চেহারা পাল্টে দেওয়া ইনিংস লিটনের আরো আছে। সে বছরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করে স্কোরবোর্ডে ২১১ রান তোলে বাংলাদেশ। ব্যাট হাতে ৪২ আর বল হাতে ৫ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন সাকিব। কিন্তু বাংলাদেশকে ২০০ এর পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন লিটন। তাঁর ৩৪ বলে ৬০ রানের ইনিংসে সে দিন দারুণ এক ভিত্তি পেয়েছিল বাংলাদেশ।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশ এই দুই ম্যাচ বাদে আরো দুইবার ২০০ রানের সংগ্রহ টপকেছে। এর একটি তো আইরিশদের বিপক্ষে গত ম্যাচেই হয়েছে। যেখানে ২০০ এর বেশি স্ট্রাইকরেট রেখে লিটন খেলেন ৪৭ রানের একটি ইনিংস। এ বাদে বাকি যে একটি ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশ ২০০ পেরিয়েছিল সেখানেও ৩৯ বলে ৫৯ রানের একটি ইনিংস খেলেছিলেন লিটন।

অর্থাৎ বাংলাদেশের ২০০ পেরোনোর সাথে লিটনের বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের একটা যোগসূত্র রয়েছে। কিছুটা সারমর্ম রূপে বললে, বাংলাদেশ যে চার বার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ২০০ পেরিয়েছে সেই চার ম্যাচে লিটনের ইনিংস ছিল যথাক্রমে ৪৩, ৬০, ৫৯, ৪৭। আর স্ট্রাইকরেটগুলো ছিল যথাক্রমে ২২৬, ২৭৬.৪৫, ১৫৬, ২০০.৪।

লিটন ব্যাট হাতে ধারাবাহিক নন। খুব সম্ভবত এই এক খামতিতেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে লিটনের সামর্থ্য, শক্তিমত্তার ব্যাপারগুলো চাপা পড়ে যায়। তবে লিটন সেই খোলস থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন। নিয়মিতই রান করছেন। নিজের ব্যক্তিগত পরিসংখ্যানও একই সাথে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

ক্যারিয়ারের পাশে ২২.৮২ গড় থাকা এ ব্যাটার সর্বশেষ ২ বছরে প্রায় ৩০ গড়ে ব্যাট করেছেন। আরো সুখকর ব্যাপার হচ্ছে, ২০২২ থেকে এখন পর্যন্ত খেলা ২৩ টি-টোয়েন্টিতে ৫ টি অর্ধশতকের দেখা পেয়েছেন লিটন। অর্থাৎ তাঁর ব্যাটিং দ্যুতির ধারাপ্রবাহটা অনেকটা সরল ছন্দিত গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশকে বরাবরই ভুগিয়েছে ইনিংসের শুরুটা। সিংহভাগ সময়েই মন্থর গতির শুরুর মাশুল গোটা ম্যাচেই দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। তবে সেই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হিসেবে যেন লিটন দাস আবর্তিত হয়েছেন। তাঁর ব্যাটেই যে এখন প্রায় ম্যাচেই উড়ন্ত শুরু পায় বাংলাদেশ। উড়ন্ত লিটনের হাত ধরে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের এই উড়ন্ত যাত্রা অব্যাহত থাকুক।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link