নড়াইল নামটি আসলেই ভেসে ওঠে চিত্রা নদীতে সাঁতার কেটে বড় হওয়া ২২ গজের এক লড়াকু যোদ্ধার নাম। কতোবার ছুরির নিচে গিয়েও ফিরেছেন নতুন ভাবে; করেছেন রেকর্ড; লিখেছেন ইতিহাস! তবে আজকের গল্পটি সেই যোদ্ধাকে নিয়ে নয়, গল্পটি একজন চ্যাম্পিয়নের।
অরণ্য; পুরো নাম অভিষেক দাস অরণ্য। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। ছোট বেলায় দেখতেন নড়াইলেই একজন পেসার ২২ গজে বোলিং ঝড় তুলে শিকার করতেন বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদের। সেই মানুষটির খেলা দেখে আগ্রহ বাড়ে ক্রিকেটের প্রতি; টেপটেনিসে শুরু হলো ক্রিকেট দীক্ষা।
আচ্ছা আপনার কি প্রশ্ন জাগছে নড়াইলেই সেই মানুষটি কে? যদি বলি দেশসেরা অধিনায়ক! তাহলে কি চিনতে পারবেন? অবশ্যই পারার কথা, পুরো বাংলাদেশ সেই মানুষটিকে চেনেন নড়াইল এক্সপ্রেস নামে। তিনি মাশরাফি বিন মুর্তজা। আর অরণ্য সেই লড়াকু ম্যাশের ছাত্র!
মাশরাফির খেলা দেখে ক্রিকেটে আগ্রহ বাড়ে ছেলেটির। ক্রিকেট বলের যাত্রা শুরু ২০১২ সালে এসে। এসে। সেবার নড়াইল জেলার হয়ে অনূর্ধ্ব ১৪ দলে খেলার সুযোগ হয়েছিলো অরণ্যের। এরপর থেকেই দুর্দান্ত পারফর্ম করে একে একে জায়গা করে নেন অনূর্ধ্ব ১৫ এবং অনূর্ধ্ব ১৭ দলে। অবশ্য ক্যারিয়ারের বাজ ফর্মের দেখাও পেয়ে যান সেই অনূর্ধ্ব ১৭ তেই! কিন্তু ভেঙ্গে পড়েননি! আচ্ছা একবার কি ভেবেছেন! ক্রিকেটে যার আদর্শ একজন মাশরাফি, সে কি এতো তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়তে পারে? না পারেনা।
বাজে সময়টা দাঁত কামড়িয়ে পার করা ছেলেটির সুযোগ হলো নড়াইলের অনূর্ধ্ব ১৮ দলে। এবার সুযোগ আসে অনূর্ধ্ব ১৯ দলের চ্যালেঞ্জ সিরিজে! কিন্তু সেখানেই ঘটে বিপত্তি! কেননা সেইসময় তিনি ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। অবশ্য এই যাত্রায় বেগ পেতে হয়নি অরণ্যকে। সেই চ্যালেঞ্জ সিরিজের প্রথম ইনিংসে তিন উইকেট নিয়ে জানান দেন প্রতিভার; সুযোগ করে নেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৯ দলে।
অবশ্য অরণ্যের শুরুটা হয়েছিলো নড়াইলের বেসিক ক্রিকেট ক্লিনিকে; সেখানে তুহিন স্যারের অ্যাকাডেমিতে সঞ্জীব বিশ্বাস সাজুর অধীনেই নিজেকে তৈরি করেন তিনি। শুধু তাই নয়, এই যাত্রায় স্পর্শ পেয়েছিলো কাপ্তান মাশরাফির! যখনি বাজে ফর্ম তখনি বন্ধু মাশরাফির শরণাপন্ন হতেন তরুণ অরণ্য!
এইসব গল্প না হয় অন্য একদিন শোনাবো। আজকের গল্পে ফিরে যাই মূল বিষয়টিতে। সেই অনূর্ধ্ব ১৯ দলে সুযোগ পাওয়া; এরপর দলের সাথে নিয়মিত দেখা যায় তাকে। কিন্তু দলের পেসার বেশী থাকায় খুব বেশী একাদশে সুযোগ পেতেননা তিনি। অবশ্য সুযোগ পেলেই দেখিয়ে দিতেন নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখা পারফরম্যান্স গুলো! দিনশেষে জায়গা হয় দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে।
স্বপ্নের ফাইনালে অরণ্যের স্বপ্নপূরণ হয় ২০২০ সালে। বিশ্বমঞ্চের ফাইনালে প্রতিপক্ষ ভারত! দ্বিতীয় বারের মতো সুযোগ হলো একাদশে; স্বপ্নের একাদশে। সুযোগ পেয়েই যেনো বাজিমাৎ! দেশ ছাড়ার আগে প্রিয় মাশরাফির টিপস গুলো হয়তো সেদিন ২২ গজে কাজে লাগিয়েছিলেন অরণ্য। তা না হলে ভারতের শিবিরে প্রথম আঘাত তো হানার কথা নয়! সেদিন ভারতের তিন ব্যাটসম্যানকে নিজের শিকারে পরিণত করে বনে গিয়েছিলেন নায়ক; স্বপ্নজয়ের লক্ষ্যে প্রথম নায়ক!
আগ্রাসী সাকিব-শরিফুলদের সাথে হাত মিলিয়ে সেদিন ভারতকে দেখিয়ে দিয়েছিলো কব্জির জোড়! ম্যাশরাফিকে দেখিয়েছিলো নিজের ভেতরে লুকিয়ে রাখা শক্তি। দূর দেশে টিভির সামনে বসে হয়তো সেদিন অরণ্যের বোলিং দেখে ম্যাশ মনে মনে বলছিলো আহ্ অরণ্য তুই যে আমাকে ২০০৭ এর সেই স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে গেলি!
আচ্ছা অনেক কিছুই তো বললাম! কিন্তু এই অরণ্য ছেলেটা আবার কে এমন প্রশ্ন কি মাথায় এসেছে? আসারই তো কথা! আচ্ছা আসুন এই অরণ্যকে। যার পুরো নাম অভিষেক দাস অরণ্য; বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য। যিনি অনূর্ধ্ব ১৯ এর ক্যারিয়ারে একজন অলরাউন্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন বহুবার। দলের প্রয়োজনে কখনো বল হাতে আবার কখনো ব্যাট হাতে ক্রিকেটের ২২ গজে প্রমান করেছেন তিনি। অনূর্ধ্ব ১৯ এ ১১ ম্যাচে ব্যাট হাতে ১৪০+ স্ট্রাইকরেটে ১০৬ রানের পাশাপাশি ডানহাতি বোলিংয়ের দুর্দান্ত আউটসুইংয়ে সর্ব্বোচ্চ ৪০/৩ উইকেটে মোট ১৫ উইকেট শিকার করেন তিনি।
অভিষেদ দাস; কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে আবারো বিশ্বমঞ্চের ফাইনালে লাল-সবুজের ৩৩ নাম্বার জার্সিতে ডানহাতে প্রিয় পুল শটে একের পর এক বাউন্ডারি মারবে আবার কখনোবা ৬ ফুটের লম্বাটে শরীর নিয়ে ছুটে এসে ২২ গজে দুর্দান্ত আউটসুইংয়ে তুলে নিয়ে পতিপক্ষের উইকেট!
তখন নড়াইল শহরের বড় কোনো পর্দার সামনে ভীড় করবে হাজরো জনতা! আর মাঠে বসে অরণ্যেই সেই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স উপভোগ করবেন মাশরাফি! আর হয়তো মনে মনে বলবে ‘সাব্বাশ অরণ্য; আমি নড়াইলকে যা করে দেখাতে পারিনি সেটা তুই করে দেখিয়ে দিলি!’ সেই দিনের অপেক্ষায়। শুভ কামনা রইল বাংলাদেশের তরুণ উদীয়মান অলরাউন্ডার অরণ্যের জন্য।